টার্নিং পয়েন্ট হবে কোনটি? by সাজেদুল হক

হ্যামলেটের হাতে খুন হন মন্ত্রী। মৃত্যু হয় প্রেমিকা ওফেলিয়ারের। সব শেষে আবার মৃত্যু। এনকাউন্টারের শব্দ। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। উইলিয়াম শেকসপিয়ারের হ্যামলেট নাটকের দৃশ্যপট ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। মৃত্যুর মিছিল চলছে। পেট্রলবোমা, গুলি, লঞ্চডুবি, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মারা যাচ্ছে মানুষ। গত দু’মাসে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন কমপক্ষে দু’শতাধিক আদম সন্তান। সর্বশেষ ব্লগার অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ড তোলপাড় তুলেছে সারা দুনিয়ায়। তিন বন্ধুর অনলাইন কথোপকথনে বার বার ফিরে আসে বাংলাদেশের এই সময়। ঢাকা থেকে সুমন, সিডনি থেকে মহিউদ্দিন আর নিউ ইয়র্ক থেকে শারমিন যোগ দেয় এ কথোপকথনে-
শারমিন: অভিজিৎ রায়ের খুনিরা কি ধরা পড়েছে?
সুমন: না এখন পর্যন্ত আমরা এমন কোন খবর পাইনি। যদিও তুমি হয়তো জেনেছো অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, পুলিশ চাইলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তার ছেলের খুনিদের গ্রেপ্তার করতে পারে। এত কাছে পুলিশ থাকার পরও তার ছেলের হত্যাকাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বিশেষ করে এত কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতর খুন করে খুনিরা কিভাবে পালিয়ে গেলো তা নিয়ে এরই মধ্যে নানা মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন এমনিতেই বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট চলছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না। এ অবস্থায় লেখক অভিজিতের নিষ্ঠুর মৃত্যু আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আচ্ছা, মহিউদ্দিন অভিজিতের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সারা দুনিয়ায় এত তোলপাড় কেন?
মহিউদ্দিন: আমরা এখন গ্লোবাল ভিলেজে বাস করি। এ গ্লোবাল ভিলেজের কোথাও কোন একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সবখানেই কোন না কোন প্রতিক্রিয়া হয়। তবে অভিজিতের বিষয়টি আলাদা। প্রথমত, বাংলাদেশে জন্ম হলেও তিনি একজন মার্কিন নাগরিক। যে কারণে এফবিআই তার হত্যার তদন্তে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয়ত, তিনি একজন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক। পশ্চিমা দুনিয়াতে মানুষের মত প্রকাশের অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সহিংসতার মধ্যেও যে কারণে এ মৃত্যু বিশ্ব মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি স্থান পাচ্ছে। তবে আমাদের উচিত এফবিআইসহ সকলের সহযোগিতা নিয়ে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা। কারণ দোষীরা বিচারের আওতায় না আসলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সুমন: শুধু পশ্চিমা দুনিয়া নয়, সবখানেই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। যে বিবেকের স্বাধীনতার কথা জন মিল্টন বলে গেছেন। মানুষ যখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা হারায় তখন সমাজে নানা সঙ্কটের তৈরি হয়।
শারমিন: বাংলাদেশে তো প্রায় দু’মাস হলো হরতাল-অবরোধ চলছে। জাতিসংঘ, পশ্চিমা দুনিয়া সঙ্কট সমাধানের জন্য বারবার আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু দৃশ্যত কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কি শুধু মুখে মুখেই উদ্বেগ প্রকাশ করছে না কোন কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। সহিংসতা বন্ধ ও সংলাপের পক্ষে তারা শক্ত কোন ভূমিকা রাখবেন কি না- তা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে না। প্রতিবেশী ভারত দৃশ্যত এখনও নীরবতা পালন করছে। তাহলে এ হরতাল-অবরোধের কি কোন শেষ হবে না?
সুমন: এ হরতাল-অবরোধের শেষ কিভাবে হবে তা আসলে সম্ভবত বাংলাদেশে কেউই জানেন না। সহিংসতা কিছুটা কমে এসেছে। সরকারের মন্ত্রী এবং তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, বিরোধীদের নির্মূল করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন। তার কিছু প্রক্রিয়া এরই মধ্যে দেখা গেছে। অন্যদিকে, বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তিনি আসলেই গ্রেপ্তার হন কি না তাই এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। অনেকেই বলছেন, তার গ্রেপ্তার রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। এরই মধ্যে ঢাকার একটি আদালত তার গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশি করতে পুলিশকে অনুমতি দিয়েছে।
মহিউদ্দিন: খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারের ব্যাপারে খুব সম্ভবত সরকার নানা ইকুয়েশন হিসাব করে দেখছে। তার গ্রেপ্তার সরকারের জন্য লাভজনক না ক্ষতিকর হবে তার অঙ্ক কষা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপের বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। জরুরি জমানার শেষ দিককার ইকোনমিস্টের একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সেসময় পর্দার অন্তরালে তৃতীয়পক্ষ যখন দুই নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করছিল, এমন একটা আলোচনাও হয় নির্বাচনে জয়ী নেত্রী পরাজিত নেত্রীকে কারাগারে পাঠাবেন না।
সুমন: তাহলে সঙ্কটের সমাধান কোথায়?
শারমিন: আপাতত সঙ্কট সমাধানের কোন পথ দেখা যাচ্ছে না। বিরোধীরা চেষ্টা করবেন তাদের আন্দোলনকে কোন একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে। সরকার চেষ্টা করবে নির্মূলের। খালেদা জিয়ার ওপর চাপ বাড়ানো হবে। তবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিতে খেলা হবে একাধিক কার্ড। কোনটি টার্নিং পয়েন্ট হয় তা-ই এখন দেখার বিষয়।
লিখেছেন: সাজেদুল হক  

No comments

Powered by Blogger.