মা-মেয়ে দগ্ধ, সংকটে পরিবার- শায়েস্তাগঞ্জে ট্রেনে পেট্রলবোমা হামলা by উজ্জ্বল মেহেদী

(শনিবার রাতে শায়েস্তাগঞ্জে চলন্ত ট্রেনে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়েছেন আমেনা বেগম (বাঁয়ে)। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন বলে চিকিৎ​সকেরা জানিয়েছেন। পাশের শয্যায় মা–ও যন্ত্রণায় কাতর। ছবি দুটি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে গতকাল সকালে তোলা l প্রথম আলো) ‘আমি বাঁচমুনি?...আমি তো মনে অয় আর বাঁচতাম না!’ অস্ফুট স্বরে গোঙানির মতো করে কথা কটা বলছিলেন আমেনা বেগম (২৫)। আর তাঁর পাশের শয্যায় মা মায়া বেগম (৫০)। আক্রান্ত মাও। মেয়ের কথা শুনে তিনি যেন সান্ত্বনার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নিজের যন্ত্রণা ছাপিয়ে কাঁদছিলেন শুধু মেয়ের জন্য।
মা-মেয়ে দুজনই সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। চলন্ত ট্রেনে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়েছেন তাঁরা। মেয়ের মুখ-চোখ আর মায়ের বাঁ হাতে দগ্ধ, ক্ষত। গত শনিবার রাত নয়টার দিকে সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের একটি বগিতে দুর্বৃত্তরা পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করলে দগ্ধ হন মা-মেয়ে। রাতেই দুজনকে সিলেটে পাঠানো হয়।
গতকাল রোববার দুপুরে মা-মেয়ের শয্যাপাশে গেলে মেয়ের অস্ফুট স্বরে গোঙানি আর মায়ের কান্না ছাড়া তাঁদের আর বলার মতো যেন কিছুই ছিল না। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার এরাইলা গ্রামে তাঁদের বাড়ি। মেয়ে আমিনা হবিগঞ্জের লাখাইয়ের একটি ক্লিনিকে মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে আয়া পদে চাকরি করেন। মা মায়া গৃহকর্মী। কুমিল্লার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন তাঁরা। রাতে ট্রেনে করে ফিরছিলেন। ওই বগিতে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে গল্প করার সময় হঠাৎ দগ্ধ হন তাঁরা। মায়া বলেন, ‘কোচ্ছু (কিছুই) কইতে পারি না। হাত পুড়ছিল, চাইয়া দেখি মেয়ের মুখ ঝলসি গেছে!’
রাতেই দুজনকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠানো হয় সিলেট ওসমানী হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। গতকাল বিকেলে তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে ওসমানী হাসপাতালের উপপরিচালক মো. আবদুছ ছালাম প্রথম আলোকে জানান, আমেনার মুখ, কান, চোখ ও গলার একাংশে দগ্ধ। মায়ার বাঁ হাতের কনুই পর্যন্ত পুড়েছে। এর মধ্যে আমেনার অবস্থা সংকটাপন্ন। ২৪ ঘণ্টা পর তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী চিকিৎসার বিষয়টি জানানো হবে।
মা-মেয়ের রোজগারে চলে সংসার। আমেনার বাবা বছর কয়েক আগে মারা গেছেন। পরিবারে তাঁর ছোট দুই ভাই রয়েছে। একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, অপরজন বাক্প্রতিবন্ধী। তাঁদের (মা-মেয়ের) এই অবস্থায় পরিবারটি কীভাবে চলবে, সে চিন্তায় মায়া বেগমকে বেশি উদ্বিগ্ন দেখা গেল। ‘আমি তো বাসা-বাড়িত কাম-কাজ করি। মেয়েটা তো মাস পুরলে টেখা পায়। ই-অবস্থায় আমি মেয়েরে দেখমু না পরিবার চালাইমু?’ কেঁদে কেঁদে এভাবেই বলছিলেন মায়া বেগম।
শায়েস্তাগঞ্জ ও শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা যায়, শনিবার রাত নয়টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট অভিমুখী আন্তনগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেস হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ প্রবেশকালে দুর্বৃত্তরা একটি বগি লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। বগির জানালা খোলা থাকায় পেট্রলবোমায় মা ও মেয়ে ছাড়াও দগ্ধ হন মাধব রুদ্র (৩০) নামের আরেক যাত্রী।
ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকা শ্রীমঙ্গল জিআরপি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরী জানান, হামলার পর শায়েস্তাগঞ্জ থানার পুলিশের সহায়তায় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে হবিগঞ্জের সাটিয়াজুড়ি ইউনিয়ন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি মো. নোমান হোসেনসহ ছয়জনকে আটক করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.