অনমনীয়তার বরফ গলছেই না

২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে প্রায় দুই মাস ধরে। এ দীর্ঘ সময়ে দেশের জানমালের যে ক্ষতি হয়েছে, তার পূর্ণ বিবরণ এই ছোট্ট সম্পাদকীয়তে তুলে ধরা সম্ভব নয়। এককথায় বললে এ ক্ষতি অপূরণীয়। আমরা বিস্মিত হই এই ভেবে যে, দুই বড় দলের নেতৃত্ব তাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতি, এমনকি মানুষের প্রাণহানি দেখেও নির্বিকার থাকছে। এই সম্পাদকীয়তেই আমরা উভয় নেতৃত্বের কাছে পৌনঃপুনিকভাবে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর আবেদন-নিবেদন জানিয়েছি। কেউ শোনেননি সে কথা। শুধু আমরা কেন, দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ, যিনি যেভাবে পারেন তাদের আকুতির কথা জানাচ্ছেন। বিদেশী বন্ধুরাও একের পর এক তাদের উদ্বেগের কথা জানাচ্ছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব পর্যন্ত চলমান সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে দুই নেত্রীকে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। পরিতাপের বিষয়, এ সবই অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়েছে।
সমস্যাটা কোথায় আমরা বুঝতে পারি না। একটা ফোন কলেই যবনিকা টানা সম্ভব বর্তমান অবস্থার। প্রধানমন্ত্রী যদি বিএনপির চেয়ারপারসনকে অথবা বিএনপির চেয়ারপারসন যদি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে সংকট উত্তরণে তাদের আন্তরিকতার কথা জানান, তাহলে বরফ গলতে শুরু করবে নিশ্চয়ই। এটা সত্য, বরফ যেভাবে জমাট বেঁধেছে, তাতে এর গলন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য অনেক তাপের প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু দুই নেত্রী যদি পরস্পরকে উষ্ণতায় আলিঙ্গন করেন, সেই উষ্ণতাই বরফ গলানোর পর্যাপ্ত তাপ সৃষ্টি করবে বৈকি। প্রশ্ন হল, তারা পরস্পর এতটা কাছাকাছি আসবেন কি-না। আমরা মনে করি, দেশ যে জায়গায় চলে গেছে, তাতে দুই নেত্রীর মধ্যে কোনো ধরনের অহং, জেদ, অভিমান, ক্রোধ ইত্যাদি থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। প্রথম কথা, মানুষকে তো বাঁচাতে হবে আগে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে যখন মানুষ মরে, তার একটা ব্যাখ্যা থাকে, যুক্তিগ্রাহ্যতা থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্যোগে মানুষ মরবে কেন? একটা সুসভ্য জাতির এমন নেতৃত্ব থাকা উচিত নয়, যারা মানুষের মৃত্যুতে বিচলিত হন না।
বারবার বলতে আমাদের খারাপ লাগে, তারপরও আমরা আবারও বিবদমান পক্ষদ্বয়ের নেতৃত্বের প্রতি আবেদন করব- থামাতে হবে এই ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতি। একটা মাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে মানুষকে এভাবে মরতে হবে, অর্থনীতির এত ক্ষতি হবে তা মেনে নেয়া যায় না। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশী কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা বলছেন, বিরোধী দলের অবস্থান কোণঠাসা হয়ে পড়লে অন্য শক্তির উত্থান হতে পারে। বলাবাহুল্য, এই অন্য শক্তি বলতে তারা পজিটিভ কোনো শক্তিকে বোঝাননি। তাই যদি হয়, তাহলে এরপরও দুই পক্ষের নেতারা সাবধান হচ্ছেন না কেন? গত ৫৪ দিনে নানাভাবে ১৪০ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছে পাঁচ শতাধিক। এসব প্রাণহানি এবং তৃতীয় অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের আশংকা- ইত্যাদি আমলে নিলে দুই পক্ষেরই নমনীয় হওয়ার কথা। কিন্তু তারা তা হচ্ছেন না। আমরা বলব, আপনারা শুধু দেশের ক্ষতি করছেন না, নিজেদের ক্ষতিও ডেকে আনছেন। সুতরাং অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান অবস্থান আরও কিছুদিন ধরে রাখলে ডুবতে হবে সবাইকেই।

No comments

Powered by Blogger.