বাল্য বিয়ে ও শূন্য বৈষম্য- যাত্রা শুরু হোক বাবার হাত ধরে by ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ

অসম্ভব অস্থির বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে শূন্য বৈষম্যের কথা ভাবার জন্যও অসীম সাহস প্রয়োজন। আমি ভিতু মানুষ। আমার এত সাহস নেই। তবে সাহসী মানুষেরা যুগে যুগে আমাদের বৈষম্যহীন সমাজের যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন সে স্বপ্ন কখনও কখনও আমার মতো ভিতু মানুষকেও সাহসী করে তোলে। মনে হয়, শূন্য বৈষম্যও সম্ভব। আন্তর্জাতিক শূন্য বৈষম্য দিবসে এ লেখাটি মূলত আমার মতো ছা-পোষা, ভিতু মানুষের জন্য। বলে নিচ্ছি যারা সাহসী, সমাজ ভাঙার জন্য কাস্তে, হাতুড়ি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত এ লেখা তাদের জন্য নয়। কেননা এ লেখায় আমি সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো, বুর্জোয়া সামাজিক ব্যবস্থা অথবা অর্থনৈতিক বৈষম্যের আস্তর্জাতিক বা জাতীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে কোনো আলোচনা করব না। বরং বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যমান সব ধরনের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় টিকে থাকা প্রাচীনতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং পরিবারের প্রধান পুুরুষ কর্তাব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করব।
২০১২ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান, রংপুরের পায়রাবন্দে একটি গবেষণার কাজে দলগত আলোচনা করছিলাম। বাংলাদেশের অন্য যে কোনো গ্রামের মতো ওই গ্রামটিতেও আলোচনার নির্ধারিত স্থানটিতে অনেক নারী-পুরুষ, শিশু একত্রিত হয়েছিলেন। ভিড়ের ভেতর ছোট একটি মেয়ে শিশুর কোলে ফুটফুটে আরেকটি শিশুর দিকে আমার নজর আটকে গিয়েছিল। ছোট শিশুটির বয়স এক-দেড় বছর অনুমান করি। আর কোলে নিয়েছিল যে মেয়েটি, সেই মেয়েটির বয়স চৌদ্দ-পনের ভেবেছিলাম। ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়েই ওর বোনকে প্রশ্ন করেছিলাম তোমার বোনটির নাম কী? মেয়েটি কোনো উত্তর না দিয়ে আমার কোল থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে দৌড় দিয়েছিল। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটির এমন আচরণের কারণ পরে জেনেছিলাম। মেয়েটির কোলে যে শিশুটি ছিল সে তার সন্তান। শুধু তাই নয়, ওই সময়টিতে সে ছিল সন্তানসম্ভবা। বিষয়টি জানার পর আমি মেয়েটির বাবার সঙ্গে কথা বলি। তিনি জানান, তার সন্তানটিকে তিনি বিয়ে দিয়েছিলেন তার একমাত্র সম্বল এক টুকরো জমি বিক্রি করে। তার ভাষ্য অনুযায়ী মেয়েটির কপালে সুখ সয়নি, তাই তার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল।
সুন্দরবনের কোলঘেঁষে থাকা গ্রামগুলোতে কক্সবাজারের সাগরের ঢেউ ছোঁয়া লোকালয়ে, সুনামগঞ্জের হাওরের মাঝের বসতিতে অথবা চলনবিলের মধ্যেও আমি আরও অসংখ্য এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। বৈষম্যের যত মাপকাঠিতেই বিচার করা হোক না কেন, যে কোনো যুক্তিতেই বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া কন্যাশিশুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। কেন এমনটা হয়? কেন একজন বাবা তার কন্যাসন্তানের বাল্যবিয়ে দেন? দেশি-বিদেশি বড় বড় গবেষক এ নিয়ে বড় বড় গবেষণা করেছেন। দারিদ্র্যসহ অনেক কারণ চিহ্নিত করেছেন। বাতলিয়েছেন সমাধানের অনেক পথ। সাধারণীকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলা যায়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই কন্যাসন্তানের বাবা থেকে গেছেন উপেক্ষিত। এদের গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করা হয়নি। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে শত শত কন্যাসন্তানের বাবার বুকে তাদের কন্যাসন্তানদের অপরিপকস্ফ বয়সে বিয়ে ও তার নির্মম পরিণতি নিয়ে যে বোবাকান্না আর অসহায়ত্ত দেখেছি, তার অর্থ গবেষক হিসেবে বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি একজন বাবাকেও খুঁজে পাইনি, যিনি তার কন্যাসন্তানের বাল্যবিয়ে দিয়েছেন কিংবা যৌতুক দিয়েছেন এজন্য যেন সে খারাপ থাকে। তারপরও কেন বাল্যবিয়ে?
দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা, পারিবারিক সম্মানহানির ভয়, মেয়ের বয়স বেশি হলে ভালো পাত্র না পাওয়া, যৌতুকের মূল্যমানের তারতম্য ইত্যাদি বিষয়কে দেশি-বিদেশি গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন কারণ হিসেবে, যা একজন বাবাকে বাধ্য করে তার কন্যাসন্তানের বাল্যবিয়ে দিতে। গত তিন বছর ধরে আমি রংপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ১১০টি গ্রামে ২০০০ কন্যাসন্তানের বাবাকে নিয়ে গবেষণা করেছি। এ গবেষণায় প্রথমে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে কন্যাসন্তানের বাল্যবিয়ে দেওয়া হয় তার কারণ খুঁজে বের করা হয়েছে। পরবর্তী সময় ওই একই গ্রামে কিংবা নিকটবর্তী গ্রামের এমন কন্যাসন্তানের বাবাদের খুঁজে বের করা হয়েছে, যারা তাদের সন্তানদের বাল্যবিয়ে দেননি। আমরা এ বাবাদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে। বোঝার চেষ্টা করেছি একই আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অন্য অধিকাংশ বাবাকে অনুসরণ না করে কেন এ অল্প সংখ্যক বাবা তাদের কন্যাসন্তানদের বাল্যবিয়ে দেননি। স্কুলে পাঠিয়েছেন।
চলনবিলের ভেতরের প্রত্যন্ত একটি গ্রামের এক বাবার কথা বলি। তার চার মেয়ে। তিনি যখন তার বড় মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তখন তার বয়স ১২ বছর। মেয়েটি স্কুলে পড়ত। খুব ভালো ছাত্রী ছিল না কিন্তু চেষ্টা ছিল। মেয়েটি বিয়ের কথা শুনে তার মাকে বলেছিল, সে বিয়ে করতে চায় না; পড়তে চায়। মা ভয়ে মেয়েটির বাবাকে বলতে পারেননি, মেয়েটিই সাহস করে তার বাবাকে বিষয়টি জানায়। সেদিনের মেয়েটি এখন একটি স্কুলের শিক্ষিকা। তার বাবাকে বুঝিয়েছিল যে, যদি তার বিয়ের জন্য অর্থ খরচ করে তবে বাকি বোনদের কী হবে। তার সংসার কীভাবে চলবে। কারণ সম্বল তো ছিল শুধু কিছু বর্গা নেওয়া জমি। মেয়েটি বলেছিল, 'বাবা তুমি আমাকে শুধু পড়ালেখা করার সুযোগ দাও, বিয়ে দিও না, আমি তোমার মেয়ে না, ভাব, আমি তোমার বড় ছেলে।'
মেয়েটির মুখ চেয়ে সাহসে বুক বেঁধেছিলেন বাবা। মেয়েটি তার প্রতিদান দিয়েছেন। নিজে ভালো করে পড়ালেখা করেছেন, বোনদের পড়ালেখা করিয়েছেন। সংসারের হাল ধরেছেন। নিজের এবং বোনদের কারও বিয়ের জন্যই যৌতুকের প্রয়োজন পড়েনি। দুই মেয়ে স্কুলশিক্ষিকা, একজন এনজিও কর্মী আর অন্যজন পড়ছেন। তাদের বাবাকে তারা কাজ করতে দেন না। মেয়েরাই সংসারের হাল ধরেছেন। বাবার কাছে তাই বড় মেয়েই এখন বড় ছেলে।
মেয়েদের পড়ালেখার পেছনে এই বাবার যে কষ্ট, যে সংগ্রাম তা লেখার অক্ষরে তুলে ধরার মতো যোগ্যতা আমার এখনও হয়নি। সমাজের সব উপহাস, বঞ্চনা উপেক্ষা করেও তিনি যেভাবে তার মেয়েদের আগলিয়ে রেখে পড়ালেখা করিয়েছেন, তার শক্তি-সাহস তিনি কোথায় পেয়েছিলেন?
রোদে কয়লার মতো কালো মুখে স্বর্গীয় হাসি নিয়ে উনি বলেছিলেন, 'শক্তি তো আমার মেয়ে, ও যখন বলল বাবা আমি তো তোমার বড় মেয়ে না, বড় ছেলে। সেদিন আল্লাহ আমাকে এই শক্তি দিয়েছিলেন। এখন আমি না শুধু, গ্রামের সবাই বলে আমি নাকি বেহেস্তি মানুষ।'
এই বাবার মতো সব বাবার গল্প একই। যেদিন থেকে তারা মেয়েটিকে ছেলের সমান ভাবতে পেরেছেন সেদিন থেকেই পরিবর্তনের পথে শূন্য বৈষম্যের পথে যাত্রা শুরু হয়েছে। তার পরিবারে শিক্ষা, চাকরি, সুস্বাস্থ্য ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে শূন্য বৈষম্যের পথে যে মেয়েরাই আজ যাত্রা শুরু করেছেন তাদের সবার ক্ষেত্রেই এ যাত্রার শুরু তাদের বাবার হাত ধরে। যখন বাবারা তাদের ছোট্ট সোনা মেয়েটিকে ছেলেটির মতো ভাবতে পারেন, সমাজের নানা প্রতিকূলতার মাঝেও তার হাতটা শক্ত করে ধরেন। তখনই শূন্য বৈষম্যের পথে যাত্রা শুরু হয়। বাবারা হয়তো থাকেন না কিন্তু মেয়েটিই বাবাকে বুকে আগলে রেখে বাঁচিয়ে রাখেন তাদের মৃত্যুর পরও। তাই বাবাদের বলব,
'চলুন, মেয়ের হাত ধরেই যাত্র শুরু হোক
শূন্য বৈষম্যের পথে'
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.