অবর্ণনীয় দুর্ভোগে গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা by কাজী সুমন

নিচতলার একটি কক্ষের মেঝে সারিবদ্ধভাবে পাতা অন্তত ২০টি বিছানা। কম্বল দিয়েই বানানো হয়েছে এ বিছানা। বালিশই বানানো হয়েছে কম্বল দিয়েই। এখানেই পালা করে ঘুমাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারী নন ত্রাণসামগ্রী হিসেবে কেনা কম্বলের বিছানাতেই রাত কাটাচ্ছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টাসহ কয়েকজন নেতা ও কর্মকর্তা। ভেতরে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় কার্যালয়ের পূর্বপাশে খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা হয়েছে নামাজের স্থান। এর পাশেই পড়ে আছে খালি পানির বোতল আর পুরনো আসবাবপত্রের স্তূপ। ২০ দিন ধরে বাইরে থেকে খাবার প্রবেশ করতে না দেয়ায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তারা। একবেলা চিঁড়া, মুড়ি-বিস্কুট খেয়ে কাটালেও অন্যবেলা একজনের খাবার ভাগ করে খান কয়েকজনে।
গত ৩রা জানুয়ারি রাত থেকেই এ পরিস্থিতির শুরু। প্রতিদিনের মতো ওই রাতে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এসেছিলেন খালেদা জিয়া। রাত সাড়ে ১১টায় নয়া পল্টনে অসুস্থ রিজভী আহমেদকে দেখতে কার্যালয় থেকে বের হতে চাইলে খালেদা জিয়ার পথ আটকায় পুলিশ। কার্যালয়ের সামনের সড়কে ১১টি বালু ও ইটভর্তি ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়। আধঘণ্টা অপেক্ষার পর বের হতে না পেরে ফের কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে মূলত এক কক্ষেই সীমাবদ্ধ তার চলাচল। মাঝেমধ্যে ড্রয়িংরুমে বাইরে থেকে আসা বিদেশী কূটনীতিক ও দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। দীর্ঘ প্রায় দুই মাসের মধ্যে মাত্র তিনবার নিচতলায় নেমেছিলেন তিনি। ৫ই জানুয়ারি বিকালে পূর্বঘোষিত সমাবেশে যোগ দেয়ার জন্য নিচে নেমে কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯শে জানুয়ারি নিচতলার কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। ২৭শে জানুয়ারি ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ এলে ওই কক্ষে নেমে শেষ বিদায় জানান। মধ্যে কয়েক দিন নাতনিদের কাছে কিছুটা পারিবারিক আবহে সময় কেটেছে তার। কিন্তু তারা চলে যাওয়ার পর ফের একাকী হয়ে পড়েন। রাতে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ও দলের সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন। সকালে নাশতা করে সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বুলান। দুপুরে খাবার খেয়ে বিকালে দুই মহিলা নেত্রীর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করেন।
এদিকে ৩রা জানুয়ারি রাত থেকেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ জীবন কাটাচ্ছেন দলের কয়েকজন নেতাসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রথম কয়েক দিন ১০-১২ জন মহিলা নেত্রী অবস্থান করলেও থাকার অসুবিধার জন্য দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা ছাড়া বাকিরা বেরিয়ে যান।
চেয়ারপারসনের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, দোতলার সাতটি কক্ষের মধ্যে দুটি কক্ষ ব্যবহার করেন খালেদা জিয়া। বাকি পাঁচটি কক্ষের মধ্যে একটিতে থাকেন সেলিমা রহমান ও শিরিন সুলতানা। রাতে ছোট্ট একটি সোফায় ঘুমান সেলিমা রহমান আর শিরিন সুলতানা ত্রাণের কম্বল মেঝেতে বিছিয়ে ঘুমান। বাকি কক্ষগুলোতে থাকেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এম এ কাইয়ুম, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাহবুব আল-আমিন ডিউ, একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার, প্রধান নিরাপত্তা সমন্বয়কারী কর্নেল (অব.) আবদুল মজিদ। তারা সবাই ত্রাণের কম্বল মেঝেতে বিছিয়ে ঘুমান। এদিকে নিচতলার কনফারেন্স রুমটির চতুর্দিকে মেঝেতে অন্তত ২০টি ত্রাণের কম্বল বিছানো। কার্যালয়ে অবস্থানরত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পালা করে ঘুমান। কেউ ঘুমান দিনে আবার কেউ রাতে। কার্যালয়ের ঢুকতেই বাঁ পাশের কক্ষটি হলো চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেলের। ছোট্ট ওই কক্ষটির একপাশে দুটি সোফা। প্রেস উইংয়ের সদস্যরাও থাকেন গণরুমে। দিনের বেলায় কার্যালয়ের পশ্চিমদিকের বেলকনিতে বসে সাংবাদিকদের নানা তথ্য দেন। ৩০শে জানুয়ারি রাতে কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও নানা মহলের সমালোচনার মুখে ১৯ ঘণ্টা পর ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে ওই রাতে বন্ধ করে দেয়া হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, ফোন-ফ্যাক্স, ক্যাবল টিভি সংযোগ। আশপাশের এলাকার কয়েকটি দূতাবাসের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ দিন পর সচল করা হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক। তবে এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে ইন্টারনেট, ফোন-ফ্যাক্স, ক্যাবল টিভি সংযোগ। ৩রা জানুয়ারি রাত থেকেই কার্যালয়ে অবস্থানরত নেতা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বাইরে থেকে তিনবেলা খাবার সরবরাহ করা হতো। সকালে গুলশান-২ এলাকার একটি রেস্তরাঁ থেকে সকালের নাশতা (রুটি-ডিম-সবজি) পাঠানো হতো। দুপুরে ও রাতে বাসায় রান্না করা খাবার (ভাত-তরকারি-ডাল) সরবরাহ হতো। কিন্তু গত ১০ই ফেব্রুয়ারি রাতে হঠাৎ করেই খাবারের ভ্যান কার্যালয়ের সামনে থেকে ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। এরপর কয়েক দিন খাবারের ভ্যান প্রবেশের চেষ্টা করা হয়। প্রতিবারই ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। এমনকি সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের আনা খাবার প্রবেশ করতে দেয়নি তারা। খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে খাবার দিতে এসে আটক হন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীনসহ বেশ কয়েকজন মহিলা নেত্রী। পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় হঠাৎ করেই খাবার প্রবেশ বন্ধ করে দেয়ায় বিপাকে পড়েন কার্যালয়ের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। কার্যালয় সূত্র জানায়, ওই রাতে অনেকেই শুধু চিঁড়া-মুড়ি, খেজুর ও বিস্কুট খেয়ে পার করেন। এ ছাড়া আরাফাত রহমান কোকোর রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া-দুরুদ পড়ার জন্য প্রতিদিনই কার্যালয়ে আসেন পাঁচজন হাফেজ। তারা আসার সময় তাবারক হিসেবে চিঁড়া-মুড়ি, খেজুরসহ কিছু শুকনা খাবার নিয়ে আসেন। কার্যালয়ের সিএসএফ সদস্য ও কিছু কর্মচারী বাসা থেকে খেয়ে আসেন। সিএসএফ সদস্যরা আসার সময় তাদের নিজের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসেন। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার জন্য বাসা থেকে তিনবেলা খাবার আসে। মাঝেমধ্যে তার মেজোবোন সেলিনা ইসলাম ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রী নাসরিন সাঈদ খাবার নিয়ে আসেন। ওই খাবারগুলো ভাগ করে খান তারা।
গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফর করে যাওয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করতে অসুস্থ অবস্থায় কার্যালয়ে এসেছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এরপর থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে কার্যালয়েই অবস্থান করছেন তিনি। খাবারের অসুবিধার কারণে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নজরুল ইসলাম খান মানবজমিনকে বলেন, বার্ধক্যজনিত নানা রোগের কারণে এক মাস ধরেই ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এখানে অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকার কারণে পীঠের ব্যথাটা আরও বেড়েছে। অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফ্লোরেই থাকতে হচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া তাদের সঙ্গে ভাগজোখ খেতে হচ্ছে। তবে সারা দেশে দলের নেতাকর্মীরা যে কষ্ট স্বীকার করে আন্দোলন করছেন, সেটা দেখলে এটাকে কষ্ট মনে হয় না। তার চেয়ে বেশি কষ্ট করছেন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, কার্যালয়ে খাবারের অনিয়মের কারণে বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থতা বোধ করছি। কয়েকদফা ডাক্তার এসে আমাকে দেখে গেছেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা নিয়ে গেছেন। তবে আমাদের চেয়ে বেশি কষ্টে আছেন আন্দোলনরত দলের নেতা-কর্মীরা।

No comments

Powered by Blogger.