জাবিতে পাখিমেলা- প্রকৃতিও ভরে উঠুক কলকাকলিতে

বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে জনপদে মেলার আয়োজন ও বৈচিত্র্য নতুন নয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ বছর ধরে আয়োজিত 'পাখিমেলা' তাতে নতুন সংযোজন বৈকি। বলা বাহুল্য, অন্য মেলার সঙ্গে এর পার্থক্যও রয়েছে। যে পাখিদের নিয়ে এই মেলা, তাতে আর যা-ই হোক প্রকৃত পাখির আনুষ্ঠানিক প্রদর্শন সম্ভব নয়; মাছের মেলায় মাছ বিক্রি হলেও এখানে পাখির বেচাকেনাও সম্ভব নয়। বস্তুত এর আয়োজকরা বরং পাখির মুক্ত বিচরণের পক্ষেই কাজ করে চলছেন। পাখির প্রতি মানুষের মমত্ব জাগিয়ে তুলতেই এমন আয়োজন। যে কারণে প্রকৃত পাখির বদলে এখানে স্থান পেয়েছে পাখির প্রতিমূর্তি। অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সত্যিকারের পাখির বিচরণও কম নয়, আমরা জানি। পরিবেশ ও প্রকৃতি সংক্রান্ত নানা নেতিবাচক ঘটনার ভিড়েও শীতকালে অতিথি পাখির কলকাকলিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়গুলো মুখরিত হয়। মেলার আয়োজন ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাধুবাদ পেতে পারে, চারপাশে নগরের আগ্রাসনের মধ্যেও তারা পাখির জন্য একটি অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে পেরেছেন। আমরা মনে করি, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলে, জলাভূমিপ্রবণ রাজধানীর উপকণ্ঠের অন্যান্য বিল-ঝিলেও অতিথি পাখির আবাহন কঠিন নয়। অবশ্য চারপাশের নদী ও জলাশয়ই যখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন সেখানে পরিযায়ী পাখির কলকাকলির চিত্র কল্পনা করা বাতুলতারই নামান্তর। এ কথাও ভুলে যাওয়া চলবে না যে, খোদ জাহাঙ্গীরনগর থেকে দূরের চেনা-অচেনা হাওরেও কিন্তু অতিথি পাখির আগমন কমে আসছে। এর কারণ হিসেবে ব্যক্তি মানুষের নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণে জাতীয় অবহেলার কথাও বলতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, বিলম্বে হলেও অন্তত ঢাকার চারপাশের নদী ও জলাশয় উদ্ধারে সরকার উদ্যোগী হয়েছে। তা আদতে কতটা কার্যকর তা বোঝার জন্যও কিন্তু অতিথি পাখির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। বস্তুত যে কোনো পরিবেশই কতটা দূষণমুক্ত রয়েছে, সেখানকার উদ্ভিদকুল কতটা প্রতিবেশবান্ধব, তা জানান দেয় পাখপাখালির কলকাকলি। রাজধানীর জলাশয় যদি কার্যকরভাবে দখল ও দূষণমুক্ত রাখা যায়; শিল্প ও নাগরিক বর্জ্য যদি জলাশয়ের পানিতে না মিশতে পারে; তাহলে কোনো এক শীতের মৌসুমে বুড়িগঙ্গা নদী কিংবা হাতিরঝিলেও অতিথি পাখি দেখা যেতে পারে। আসলে অতিথি বা দেশীয় যে কোনো পাখিরই স্বচ্ছন্দ বিচরণ দেখতে হলে সাধারণ মানুষকেও উদ্যোগী হতে হবে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, উদ্ভিদ, প্রাণী মিলে যে প্রতিবেশ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তার অন্যগুলো ধ্বংস করে কেবল বিচ্ছিন্নভাবে পাখির উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাবে না। আমরা জানি, ভৌগোলিকভাবে হিমালয় পার্বত্যাঞ্চল, বঙ্গোপসাগর আর দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ সমভূমির মিলনস্থল বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে খুবই সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু নির্বিচারে বন-জঙ্গল উজাড়, জলাভূমি ভরাট আর জনবসতির কারণে গত কয়েক দশকে তার ব্যাপক অবনতি হয়েছে। আবাসস্থল বিনষ্ট, খাদ্যের অভাব এবং প্রতিকূল পরিবেশের কারণে স্বভাবতই বিপন্ন কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে আমাদের পাখি, উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী। পাখিমেলার মাধ্যমে পাখি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মতো আমাদের প্রতিবেশ ব্যবস্থার অন্যান্য সদস্যের প্রতিও সবাই মনোযোগী হোক।

No comments

Powered by Blogger.