চাচার পাঁচালি: সাত-স by মাহবুব তালুকদার

দেশের অবস্থা দিনে দিনে ঘোরালো হয়ে যাচ্ছে। এর শেষ কোথায় তা কেউই বলতে পারছেন না। টেলিভিশনের খবর, টকশো, আর পত্রিকা  পড়ে আমি রীতিমত বিভ্রান্ত। মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আমার মস্তিষ্কে চিন্তার জট পাকিয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মিডিয়া কি ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করছে, নাকি তার ভূমিকা নেতিবাচক, এ প্রশ্নটা এখন আমার কাছে বড়। আরেকটা বিষয় আমি বুঝতে অপারগ। ক্ষমতাসীনরা সবসময় টকশো সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন। কিন্তু বিগত কিছুদিন যাবৎ আমার মনে হচ্ছে, টকশোতে গুণগত পরিবর্তন তেমন না হলেও মুখের পরিবর্তন হচ্ছে। এখন নতুন মুখের বক্তারা সরকারের পক্ষে কথা বলছেন। মাত্র কয়েকজন ছাড়া সরকারের সমালোচনা করার জন্য খুব বেশি বিজ্ঞজন নেই। কেউ কেউ টকশো-কে ‘সুইট শো’ বলছেন। এ অবস্থায় টকশো সম্পর্কে সরকারের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে কি?
চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বর্তমান সঙ্কটাপূর্ণ অবস্থায় মিডিয়ার ভূমিকা কি ঠিক হচ্ছে?
মোটেই না। চাচা চললেন, আমাদের পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ওয়ার্কার্স পার্টির সমাবেশে সেদিন বলেছেন, গণমাধ্যম যদি ‘একদিন’ তথাকথিত হরতাল-অবরোধের খবর প্রচার না করতো তাহলে এমনিতেই তা বন্ধ হয়ে যেত।
এটা তো খুব আশাব্যঞ্জক কথা। মিডিয়ার মালিকরা একজোট হয়ে অন্তত তিনদিন হরতাল-অবরোধের খবর প্রচার না করলে, দেশব্যাপী সন্ত্রাস নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্তু তা সম্ভব নয়। সরকার যদি একদিনও এসব খবর প্রচার বন্ধ রাখে, তাহলে তোমরাই বলবে, মিডিয়ার কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। কয়েকদিন আগে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, এ দেশে গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীন। সরকার মিডিয়ার ওপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করছে না। তথ্যমন্ত্রী খুব গুরুত্ব সহকারে বলেছেন কথাটা।
চাচা: পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে কেমন গোলমেলে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
এর অর্থ কি বাংলাদেশের গণমাধ্যম যথেষ্ট স্বাধীন নয়? অন্যদিকে, অতি সম্প্রতি সম্পাদক পরিষদ অভিযোগ করেছে যে, সরকার গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ করছে। তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছেন না। এর জবাব কি?
আমার প্রশ্নের জবাব পাশ কাটিয়ে চাচা বললেন, মিডিয়ার কথা থাক। তুমি তো নতুন রাজনৈতিক-তাত্ত্বিক হওয়ার চেষ্টা করছো। দেশের অবস্থা সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কী, বলো।
চাচা: বাংলাদেশ এখন সাতটি ‘স’-এর শব্দে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এর অর্থ কি? কথা সহজ করে বলতে পারো না?
বলছি। এই সাত ‘স’ হচ্ছে সমস্যা, সন্ত্রাস, সঙ্কট, সংঘাত, সংলাপ, সনদ ও সমঝোতা। সমস্যা থেকে সন্ত্রাসের উৎপত্তি। ফলে সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। এখন সংলাপ, সনদ ও সমঝোতার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
তুমি কৌশলে সংলাপ, সনদ ও সমঝোতা- এ তিনটি শব্দ এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছো। তা হবে না। এ সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো শেষ কথা বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট যা করছে তা জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। আমরা এই দানবদের কোন ছাড় দেবো না। দানবদের কাছে মানুষ হারতে পারে না। আমরা এই দানবদের প্রতিহত করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনবো।’
একতরফা শান্তি প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব?
যারা মানুষ পুড়িয়ে মারছে তাদের নিধন করলেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমও বলেছেন, অবরোধ-হরতালে যারা নাশকতা করছে, তাদেরকে প্রয়োজনে এনকাউন্টারে মারার ব্যবস্থা করা হবে।
কিন্তু সেটা কবে? একদিকে অবরোধ-হরতালে ১০০ জনের বেশি মানুষ পুড়িয়ে মারা হলো। অন্যদিকে আমাদের বার্ষিক আয়ের প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। আমি বললাম।
সত্যি বলতে কি, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি ভাবতে পারছি না যে, কেবল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিরা ঘন ঘন কঠোরতম ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তার অনুমোদনও আছে। গুলি হত্যা গুম ক্রসফায়ার বন্দুকযুদ্ধ ও ট্রাকের চাপায় মৃত্যু- এসব চলছে। এতদসত্ত্বেও পেট্রলবোমা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অবসান ঘটছে না।
আমি বললাম, চাচা! ধরুন আপনি ১৪ দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন আর আমি ২০ দলের। আমাদের মধ্যে কি সংলাপ হতে পারে না? এখন যেমন চলছে।
তোমাদের হরতাল-অবরোধ তুলে নিলে সংলাপের ব্যাপারটা হয়তো ভেবে দেখা যেতে পারে। একটা ঘোষণা দিয়ে হরতাল-অবরোধ তুলে নিতে অসুবিধা কি?
সহসা অবরোধ তুলে নিলে যেসব নেতাকর্মীকে জেলে নেয়া হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যারা দিনের পর দিন ঘরবাড়ি ছেড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের কি হবে? কোন ফয়সালা ছাড়া হরতাল-অবরোধ তুলে নেয়া সম্ভব নয়। বরং সুশীল সমাজের ডাকে সাড়া দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের পথ বেছে নিতে অসুবিধা কি? তাকে তো এখনই বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে বসতে বলা হচ্ছে না।
আমার কথায় চাচা রীতিমতো ক্ষেপে গেলেন। বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ? সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোন আলোচনায় বসলে প্রকারান্তরে সন্ত্রাসই জয়যুক্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী এ জন্য সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোন আলোচনা করতে পারেন না। তাছাড়া, সংলাপের জন্য আগ বাড়িয়ে বারবার তিনি কেন অপমানিত হবেন?
আলোচনার এই পর্যায়ে চাচি এসে ঘরে ঢুকলেন। ট্রে হাতে তার ধূমায়িত চায়ের কাপ। চাচা ও আমার সামনে চায়ের কাপ রাখলেন তিনি। আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। বললেন, কি নিয়ে আলাপ হচ্ছে?
দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমরা উভয়েই শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। আমি জানালাম।
উদ্বিগ্নতার কিছু নেই। চাচি একদিকের সোফায় বসতে বসতে বললেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশীরা ঢুকে পড়েছে। এখন একটা কিছু ফয়সালা হয়ে যাবে।
কী যা-তা বলছো? যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। চাচা উষ্মাভরে বললেন।
তার কথায় বিন্দুমাত্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না চাচি। বললেন, কি বুঝি না?
রাজনীতির তুমি কী বোঝ?
রাজনীতি! কথাটা উচ্চারণ করে মৃদু হাসলেন চাচি, তুমি বোধহয় ভুলে গেছো আমি একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। আমার আব্বা ষাটের দশকের আইউব বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, আমাদের বাড়ি ছিল একটা রাজনৈতিক ঘাঁটি। কত বড় বড় রাজনীতিবিদ আমাদের বাড়িতে বসে দেশের স্বাধীনতার জন্য আলোচনা করতেন।
বললাম, চাচি! আপনি বসুন। কি বলতে চেয়েছিলেন, কথা শেষ করুন।
আমি বলছিলাম, আমাদের দেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশীরা যখন ঢুকে পড়েছে, তখন যে কোন ধরনের একটা ফয়সালা তো হবেই। আমাদের সঙ্কট নিয়ে জাতিসংঘ, ভারত, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন- এদের চাপ দিনে দিনে বাড়ছে।
তারা কে? আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের কোন হস্তক্ষেপ করতে দিচ্ছি না। চাচার কণ্ঠে বিরক্তির স্বর।
কথাটা ঠিক নয়। চাচি বললেন, নিকট অতীতে এবং অতীতে এর অনেক প্রমাণ আছে। এক-এগারোর সময় বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা প্রতি মঙ্গলবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বৈঠক করতেন, যা ‘টুইস ডে গ্রুপ’ নামে পরিচিত ছিল। এরা এমন অবস্থার সৃষ্টি করেন যাতে এক-এগারোর পথ সুগম হয়।
চাচা অধিকতর বিরক্তকণ্ঠে বললেন, তখনকার কথা এখন বলে লাভ কি? শেখ হাসিনার সরকার এখন বিদেশীদের ব্যাপারে মোটেই পাত্তা দেয় না। ড্যান মজিনার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ী সাক্ষাৎকার না হওয়া তার প্রমাণ।
ঠিক আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের সচিব সুজাতা সিং যখন বাংলাদেশে এসে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য চাপ দিয়েছেন, তখন তো প্রতিবাদ জানানো হয়নি। কারণ ঐ চাপ সরকারের পক্ষে ছিল।
চাচা ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললেন, সেটা ছিল ব্যক্তি পর্যায়ের আলোচনা। কিন্তু কোন বিদেশী রাষ্ট্রদূত আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাক, আমরা তা চাই না। আমাদের একটা আত্মমর্যাদাবোধ আছে।
চাচার বক্তব্য শুনে চাচি হাসলেন। বললেন, আত্মমর্যাদা অবশ্যই আছে। তবে ক’দিন আগে যখন ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বর্তমান সঙ্কট সম্পর্কে সকল পক্ষকে তাদের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেন, তখন আমরা তার প্রতিবাদ করলাম না কেন? কেন বলতে পারলাম না, আমাদেরকে নসিহত করার জন্য তুমি কে হে বাপু? চাচি আরও বললেন, রবার্ট গিবসন কিন্তু তার বিবৃতিতে পুড়িয়ে মানুষ মারার নিন্দা করেননি। অতি সতর্কতার সঙ্গে লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন, যাতে উভয়পক্ষের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা আছে।
কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করে আমার মনে হলো, চাচি সত্য কথাই বলেছেন। এরপর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে কথা বলতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো নিশ্চয়ই এ দেশে আসবেন। আসবেন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালও। সরকার কি তখন রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের চরিত্রের মতো তাদের বলতে পারবে, ‘তফাত যাও! তফাত যাও!’

No comments

Powered by Blogger.