রূপগঞ্জে আতংক মেয়রের আদালত by এ হাই মিলন

তিনি মেয়র বটে! তার পৌর কার্যালয়ে বসে আদালত। প্রতি শুক্র ও শনিবার চলে কার্যক্রম। তিনি অনেকটা দম্ভোক্তি করেই বলেন- আমার আদালতের চেয়ে বড় কি আছে। এ আদালতে ফৌজদারি ও দেওয়ানিসহ সব বিষয় নিষ্পত্তি করা হয়। আর জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি বা বিচার এখানে করা হয় অনেকটা স্বপ্রণোদিতভাবেই। প্রচলিত আদালতের ‘হাজিরাপত্রের’ আদলেই রীতিমতো ‘বাদী’ ও ‘বিবাদীদের’ কাছে নির্ধারিত সময়ে ‘বিচারালয়ে’ হাজির হতে নোটিশ পাঠানো হয় ওই কার্যালয় থেকে। মেয়রের স্বাক্ষরসংবলিত পৌরসভার প্যাডে এ নোটিশ পাঠানো হয়। পরে দুই পক্ষের উপস্থিতিতে মেয়র দেওয়ান আবুল বাশার বাদশা বিচার বা সালিশের রায় ঘোষণা করেন। স্থানীয়রা তাই এর নাম দিয়েছে ‘মেয়রের আদালত’। গত বছরের আগস্ট মাসে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত তার আদালতে ১৫০টি বিচার-সালিশ হয়েছে বলে পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে। অথচ গ্রাম্য আদালত-২০০৬ আইনে উল্লেখ আছে, পৌরসভায় গ্রাম্য আদালত বসানোর কোনো বিধান নেই। আর পৌরসভা ম্যানুয়েল ১১১ আইনে আছে, মেয়র সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা জরিমানার রায় দিতে পারবেন। কথিত এ আদালতে জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেয়রের নিজের কিছু লোক রয়েছে। এরাই বিচার-সালিশের ব্যবস্থা করে থাকেন। কেউ সমস্যায় পড়লে মেয়রের বরাবর আবেদন করতে হয়। আবেদন করতে হলে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পৌরসভায় ফি হিসেবে জমা দিতে হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই পক্ষকেই হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ প্রদান করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নোটিশ প্রদানের পর যে পক্ষ বেশি টাকা দিতে পারে, সে পক্ষেই রায় দিয়ে নিষ্পত্তি করা হয়। আবার মেয়রের অনুপস্থিতিতে এসব সালিশ করে থাকেন তার চাচাতো ভাই দেওয়ান মুকুল, আলাউদ্দিন মাস্টার। মেয়রের উপস্থিতিতে সালিশ হলে টাকা আদান-প্রদান থেকে শুরু করে সব কিছু করে থাকেন ওই দেওয়ান মুকুল। তার সঙ্গে রয়েছেন- পলাশ মিয়া, তুষার দেওয়ান, কমরউদ্দিন, হাসমত আলী, ভাগিনা মিলন, জসিম মিয়া, খালাতো ভাই সুজাউদ্দিন, দেওয়ান বাবুল, মাহফুজ মিয়া। এদের কাজ এলাকায় ঘুরে ঘুরে জমিসংক্রান্ত ঝামেলা, মারামারির ঘটনাসহ নানা বিষয়ে ভুক্তভোগীদের খুঁজে বের করে মেয়রের বরাবর আবেদন করতে বাধ্য করা। আবার অনেকে নিজ থেকেও আবেদন করে থাকেন। তবে এর সংখ্যা অনেক কম। এছাড়া বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষকে হুমকি-ধমকি দেয়াও তাদের কাজ বলে জানা গেছে। এরাই রায়ের জুরি বোর্ডে থাকেন। যে পক্ষ টাকা বেশি দেয়, তাদের পক্ষেই রায় নিষ্পত্তি হয়। আর এ টাকাও হাতিয়ে নেয় তারা।
নিজেদের বিচার প্রক্রিয়াকে বৈধ দাবি করে দেওয়ান আবুল বাশার বাদশা বলেন, ‘লোকজন আমাদের কাছে আসে বিচার নিয়ে। এটা খারাপ কি? তাদের থানায় ও আদালতে যেতে হল না। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত শতাধিক অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছি।’
জমিজমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ওই আদালত থেকে গত সাত ডিসেম্বর বিবাদীকে দেয়া একটি নোটিশের ভাষা ছিল এ রকম- ‘আপনার সদয় অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, বাদীর সঙ্গে আপনার বিবাদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আগামী ১৬-১২-১৪ তারিখ রোজ মঙ্গলবার বেলা ১০ ঘটিকায় প্রয়োজনীয় সাক্ষী ও কাগজপত্রসহ কাঞ্চন পৌরসভা কার্যালয়ে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হইল। দেওয়ান আবুল বাশার বাদশা, মেয়র, কাঞ্চন পৌরসভা, নারায়ণগঞ্জ।’
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, মানুষ শান্তির আশায় তাকে ভোট দিয়েছিল। এখন তিনিই পৌরবাসীর জন্য মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচনের আগে তিনি আধুনিক পৌরসভা গড়ে তোলার জন্য পৌরবাসীকে বেশকিছু পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। অথচ সেসবের কোনোটিই তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তিনি পৌরসভার উন্নয়ন বাদ দিয়ে আদালত বসিয়ে বিচার-সালিশ করা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
কেরাব এলাকার কৃষক আবদুল আলী। কথা না শোনার কারণে মেয়রের আদালতে তার দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া দু’দিন পৌর কার্যালয়ে আটক রাখা হয়। কথা হয় আবদুল আলীর সঙ্গে। তিনি অনেকটা কষ্টের সুরে বলেন, ‘বাজান আমার কোনো অপরাধ আছিলো না। হেয় (মেয়র) আমারে নোটিশ কইরা ডাকছিলো। হের ডাহে যাই নাই ক্যান। হের লেইগ্যা দুই লাক টেকা জরিমানা করছে। আর দুই দিন হের অফিসে আটকাইয়া রাখছে। পরে টেকা দিলে ছাইড়া দেয়। হেরে ভোট দিলাম শান্তির লাইগা। আর হেয়ই অশান্তি করে। যে জায়গাডা লইয়া ডাকছে, হেইডা লইয়া কোডে (কোর্টে) মামলা চলতাছে। কন কোডে মামলা চললে হের কাছে যামু ক্যান। হেয় কয় ওনার হেনই এইডা শেষ করতে অইবো। তয় কোড বানাইলো ক্যান সরকার।’ কাঞ্চন এলাকার জায়ফল বেগম। ব্যাংক থেকে নিলামে ২০ শতক জমি কিনেন। নিলামকৃত জমি হাসিনা বেগম নামে এক মহিলা নিজের দাবি করে পৌরসভায় অভিযোগ দায়ের করেন। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র নোটিশ করেন। যথারীতি গত বছরের ২৯ অক্টোবর হাজিরার দিন ধার্য করলে জায়ফল বেগম ওই দিন না গিয়ে পরে মেয়রের কাছে যান। তারা মেয়রকে বুঝাতে চেষ্টা করেন, এ জমি নিয়ে কোর্টে মামলা রয়েছে। যে কোনো সময় রায় হবে। এসব কথা কর্ণপাত না করে মেয়র তাদের বলেন, কোর্টের চেয়ে বড় আদালত আমার। যদি আগামী হাজিরায় উপস্থিত না হন তাহলে চৌকিদার দিয়ে ধরে আনা হবে। পরে জায়ফল বেগম কোর্টের মাধ্যমে মেয়রকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করান। জায়ফল বেগম বলেন, ‘বাবা এইডা কিমুন জোরজবরদস্তি? ওনার আদালতই নাকি বড়। ওনার ওখানে না গেলে চৌকিদার দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিছে।’
নোটিশ পেয়ে কথিত আদালতে যেতে বাধ্য হয়েছেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ রকম বহু ব্যক্তি বলেছেন, মেয়র প্রভাবশালী। তাই তার ডাকে যেতে হয়। না গেলে নানাভাবে হয়রানি করে। মেয়র দেওয়ান আবুল বাশার বাদশা সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আদালত বসাই না। সালিশি বোর্ড বসে। নোটিশ পাঠানোর এখতিয়ার পৌর আইনে আছে। আর এর জন্য যে টাকা নেয়া হয় তা পেয়াদার (চৌকিদার) খরচ বাবদ। আদালতের মতো পৌরসভায় বিচার করার যৌক্তিকতা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৌরসভা হচ্ছে গ্রাম্য আদালত। বিচার করা যাবে না কেন। তার লোকজনের ব্যাপারে বলেন, তারা আত্মীয়স্বজন, থাকতেই পারে। সেলফোনে কথা হয় অভিযুক্ত দেওয়ান মুকুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিচার-সালিশ করার বিধান রয়েছে মেয়রের। আমি কোনো বিচার করি না। হয়তো উপস্থিত থাকি। ২০০৪ সালের ৫২ ধারায় আছে, মেয়র স্থানীয় বিচার-সালিশ করতে পারবে। এছাড়া অন্যদের ব্যাপারে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে এগুলো সব অপপ্রচার।
রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মাহমুদুল ইসলাম বলেন, আদালত বসিয়ে বিচারের বিষয়টি শুনেছি, এ নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল বাশার রুবেল বলেন, জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি হবে দেওয়ানি আদালতে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তা আইনের পরিপন্থী। এ ধরনের বিচার-সালিশকারীদের বিরুদ্ধে আদালত চাইলে স্ব-উদ্যোগে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। অ্যাডভোকেট আমিরুল ইসলাম বলেন, পৌরসভা ম্যানুয়েল ১১১ আইনে আছে, মেয়র সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবেন। এর বেশি কিছু করার বিধান নেই।
উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভূমি ) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এ রকম আদালতের ব্যাপারে জানা নেই। তবে যদি করে থাকেন তাহলে এটা আইনসম্মত নয়। আর জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য ভূমি অফিস কিংবা আদালত রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লোকমান হোসেন বলেন, রূপগঞ্জে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প জমি কিনছে। ফলে জমি বেচাকেনার ধুম পড়েছে। একজন জমির ভুয়া দলিল তৈরি করে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে এ ধরনের অভিযোগ এলে তিনি তা দেওয়ানি আদালতে পাঠিয়ে দেন। আদালতের বাইরে কোনো আদালত বসিয়ে ভিন্ন পন্থায় বিচার কাজ হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। তবে পৌরসভার জরিমানা বা সাজা দেওয়ার কোনো বিধান নেই। ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.