কার্যালয়েই মাস পার খালেদা জিয়ার by শফিকুল ইসলাম

রাজধানীর গুলশানের নিজ কার্যালয়েই এক মাস পার হলো বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। এ সময়ে কখনো পুলিশি বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ, কখনো বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে ছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এরই মধ্যে ইন্তেকাল করেছেন তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। ছেলের শোক কাটতে না কাটতেই গত শুক্রবার গভীর রাতে কার্যালয়ের বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। একে একে বিচ্ছিন্ন করা হয় ডিশ লাইন, ইন্টারনেট ও টেলিফোনসংযোগ। তারপর কয়েকটি মোবাইল সিমের নেটওয়ার্কও বন্ধ করা হয় খালেদার কার্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায়। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। কার্যালয়ের যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ থাকায় কর্মকর্তাদের দাফতরিক কাজকর্মও ব্যাহত হচ্ছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত এসবের সংযোগ দেয়া হয়নি। তবে প্রায় ২০ ঘণ্টা পর গত শনিবার রাতেই বিদ্যুতের সংযোগ পুনরায় স্থাপন করা হয়।
এ দিকে হঠাৎ করেই বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় ঘিরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বেড়েছে। কার্যালয়ে প্রবেশে অঘোষিত কড়াকড়ি দেখা গেছে। চাইলেই যে কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না গোয়েন্দা পুলিশ। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ ও কার্যালয়ের উত্তর দিকে কিছু মহিলা পুলিশকেও দেখা গেছে।
খালেদা জিয়া কার্যালয়ে আসার ঘটনা : প্রতিদিনের মতো গত ৩ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে গুলশানের নিজ কার্যালয়ে আসেন খালেদা জিয়া। সেখানে দলের কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলেন তিনি। পরে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অসুস্থ হওয়ার খবর জানতে পারেন। তাকে দেখার জন্য নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেতে চান খালেদা জিয়া। নেতানেত্রীদের সাথে বৈঠকের পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে খালেদা জিয়া নয়া পল্টনে যেতে চাইলে পুলিশ তার পথ আটকায়। রাত পৌনে ১২টার দিকে খালেদা জিয়া বাসায় যাওয়ার জন্য পুলিশকে ব্যারিকেড সরাতে বলেন। কিন্তু তা না সরানোয় কিছুণ গাড়িতে অপো করে ফের কার্যালয়ের দোতলায় যান তিনি। এরপর সেখানেই তার রাত কাটে। পরের দিন কার্যালয়ের মেইন গেটে ঝুলানো হয় তালা। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও তল্লাশি চালিয়ে মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। দুই শতাধিক পুলিশ দিয়ে পুরো গুলশান এলাকা কর্ডন করে রাখা হয়। এখনো পল্টন কার্যালয়ে ঝুলছে তালা। কোনো নেতাকর্মীকে সেখানে প্রবেশ করতে দেখা যায়নি।
ট্রাকের ব্যারিকেড : ৪ জানুয়ারি সকালে গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কে বিএনপি নেত্রীর কার্যালয় ঘিরে পুলিশি নিরাপত্তা আরো বাড়ানো হয়। সড়কের দুই মাথায় বসানো হয় দু’টি তল্লাশি চৌকি। ওই সড়কে পুলিশ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। কার্যালয়ের পাশেই বড় আকারের দুটো গাড়ি আড়াআড়িভাবে রেখে বেরুনোর পথও আটকে দেয়া হয়। র‌্যাব, পুলিশের সাঁজোয়া যানও প্রস্তুত রাখা হয়। শুরু থেকে কার্যালয়ের বাইরে রাস্তায় মোট ১১টি বালু ও ইটের ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে সেগুলো সরিয়ে নেয়া হয়। সর্বশেষ কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় পুলিশের দু’টি পিকআপ ও একটি জলকামান আড়াআড়িভাবে রাখা ছিল; যা ১৮ জানুয়ারি গভীর রাতে সরানো হয়। টানা ১৬ দিন পর অবরোধ মুক্ত হন খালেদা জিয়া।
গত ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন খালেদা জিয়া। মহিলা দলের নেতাকর্মীরা গেট খুলে দেয়ার দাবিতে স্লোগান দিলে দুই দফা পেপার স্প্রে করে পুলিশ। পরে খালেদা জিয়া প্রায় ৪৫ মিনিট পর গাড়ি থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। সমাবেশ করতে না দেয়ায় অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন তিনি। খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেয়ার সময়ও পেপার স্প্রে করে পুলিশ। এতে তিনিসহ মহিলা দলের ১০ জন অসুস্থ হন। তিন দিন অসুস্থ ছিলেন খালেদা জিয়া। মূল ফটকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার কারণে তিনি বের হতে পারেননি। পরে সেখান থেকেই সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
ডিশ, ইন্টারনেট ও টেলিফোনসংযোগ বিচ্ছিন্ন : এ দিকে গত শুক্রবার রাত ২টা ৩৭ মিনিটে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পর্যায়ক্রমে ডিশ লাইন, ইন্টারনেট ও টেলিফোন লাইনের সংযোগও কেটে দেয়া হয়। গতকাল সোমবার পর্যন্ত গুলশান কার্যালয়ের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তথ্যযোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো পুনঃস্থাপিত হয়নি। মোবাইল নেটওয়ার্ক, টিঅ্যান্ডটি টেলিফোন, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ড ইত্যাদি যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ হয়ে আছে। টেলিভিশনের ক্যাবল লাইনও কেটে দেয়া আছে। কার্যালয়ের যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ থাকায় কর্মকর্তাদের দাফতরিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান জানিয়েছেন, কার্যালয়ের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ থাকায় আমরা সব ধরনের যোগাযোগ থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। খবরাখবর আহরণে আমাদের এক মাত্র মাধ্যম এখন পত্রপত্রিকা। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো পড়েন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দুই নাতনী জাফিয়া ও জাহিয়া দাদীর সাথে মাঝে মধ্যে সময় কাটাচ্ছে। রাতে তারা দাদীর সাথে ঘুমাচ্ছে। সকাল-বিকেলে পালাক্রমে কোকোর স্ত্রী শামিলা রহমান সিথি, দুই ভাইয়ের স্ত্রী নাসরিন সাঈদ ও কানিজ ফাতেমা পালাক্রমে গুলশানের কার্যালয়ে এসে কথা বলছেন।
মাঝে মধ্যে বিশিষ্টজন ও মেহমানেরা ছেলে শোকে কাতর বেগম জিয়াকে সান্ত্বনা জানাতে তার সাথে সাাৎ করছেন। গত ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় বসবাসরত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো হৃদরোগে মারা যান। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসনের সাথে কেউ দেখা করতে যাননি। সর্বশেষ রোববার রাতে পেশাজীবী নেতারা বেগম জিয়ার সাথে দেখা করেন। কোকোর মৃত্যুতে গতকাল কার্যালয়ে গিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করেছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর আশরাফিয়া মাদরাসার শিক্ষক দীন মোহাম্মদসহ কয়েকজন।
কার্যালয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি : খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশের ব্যাপারে ফের কড়াকড়ি আরোপ করেছে পুলিশ। চাইলেই যে কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। গতকাল দেখা গেছে, কেউ কার্যালয়ের গেট ঘেঁষলেই গোয়েন্দারাও কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন। শুধু কার্যালয়ের নিয়মিত স্টাফ ও খালেদা জিয়ার স্বজন ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এত দিন সাংবাদিক পরিচয় দিলে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হলেও গতকাল কেউ প্রবেশ করতে পারেনি। কার্যালয়ের সামনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের সরিয়ে উত্তর পাশে কিছু দূরে রাখা হয়েছে।
কার্যালয়ের সামনে আটক ১ : এ দিকে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের ভেতরে ঢোকার চেষ্টাকালে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আটক ব্যক্তির নাম মাজহারুল ইসলাম। তিনি গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজের কাজ করেন বলে জানান। তার সাথে একটি ব্যাগ ছিল। ব্যাগে একটি মোবাইল ফোন ছিল। তবে কেন তিনি কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে চেয়েছেন তা জানা যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.