দুই বেলা খাবারই জুটছে না দেড় লাখ হকার পরিবারে- বকেয়া পড়ছে ঋণের কিস্তি:শীত মওসুমে ব্যবসায় নেই:দুর্দিন by জিয়াউল হক মিজান

(রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাথে ক্রেতাশূন্য হকারদের দোকান : মোহাম্মদ শরীফ) রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ পাশের ফুটপাথে সাত বছর ধরে হকারি করেন চাঁদপুরের যুবক তাহেরুল। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন জুরাইনে। আট হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু করা ব্যবসায়ের টাকাতেই চলছিল তাহেরুলের সংসার। তিন ফুট বাই চার ফুট আকারের চৌকির ওপরে গরম কাপড় বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং টানা অবরোধ তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। অভাবের তাড়নায় লাভের আশায় প্রতিদিনই দোকান খুলে বসেন। কিন্তু বেচাকেনা নেই বললেই চলে। স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা বিক্রি হতো, অবরোধের কারণে বিক্রি নেমে এসেছে এক থেকে দেড় হাজারে। কোনো কোনো দিন বউনিও হয় না। কিন্তু ঘর ভাড়া এবং বাজার খরচ তো করতেই হচ্ছে।
নিজের দুর্দশার কথা জানাতে গিয়ে তাহেরুল নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘তিনডা সমিতি থেইকা লোন নিছি। প্রতিদিন কিস্তি দিতে হয় ৪৫০ টাকা। অথচ এমনও দিন যাইতাছে ৪৫০ টাকা বিক্রিও অয় না। শীতকাল আসায় মওসুমি মাল হিসেবে গরম কাপড় উঠাইছি, শীত তো চইল্লা গ্যালো। এহন এই মাল কী করমু?’ তিনি বলেন, ‘কিস্তির টাকা দিতে পারতাছি না, বাসার বাজারও করবার পারতাছি না। বেচাকিনা নাই, পুঁজি ভাইঙ্গা খাইতাছি। যেইভাবে চইলতাছে সব ফালাই থুইয়া বাইত যাওন ছাড়া উফাই (উপায়) নাই।’
কেবল তাহেরুল নন, এমন দুর্দিন যাচ্ছে রাজধানীর ঢাকার দেড় লক্ষাধিক হকারের। নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে তাদের পরিবারে এখন প্রতিদিন দু’বেলা খাবারও জুটছে না। টানা হরতাল অবরোধে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্বল্প আয়ের এসব মানুষ। অর্ধেকের বেশি হকার ইতোমধ্যে দোকান খোলাই বন্ধ করে দিয়েছেন। উপায়ান্তর না দেখে অনেকে ঢাকা ছেড়েছেন। যারা এখনো টিকে আছেন তাদের পুঁজিও কমে আসছে।
সরকারি-বেসরকারি হিসাবে রাজধানী ঢাকার গুলিস্তান, স্টেডিয়ামসংলগ্ন ফুটপাথ, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, রেলওয়ে হকার মার্কেট ফুটপাথ, টিঅ্যান্ডটি ফুটপাথ, বঙ্গবাজার, নীলতে, গাউছিয়া, নিউমার্কেট ও ফার্মগেট এলাকার ফুটপাথগুলো সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হরতাল-অবরোধেও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের চাঁদাবাজি থামেনি। বন্ধ হয়নি বিভিন্ন সংস্থা-সমিতির দেয়া উচ্চ সুদহারে ঋণের কিস্তিও। দোকান বন্ধ রেখে যারা কিস্তি ও চাঁদার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন তাদের ওপর নেমে আসছে ভিন্ন ধরনের চাপ। মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে পাওয়া ফুটপাথের দখলটিও হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অবরোধের কারণে।
হকারদের মতো ভালো নেই বিপণিবিতানগুলোর দোকানিরাও। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং মার্কেট কমিটির চাপে হরতাল-অবরোধেও দোকান খুলতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। অথচ সারা দিন দোকান খোলা রেখেও মিলছে না ক্রেতার দেখা। রাজধানীর পলওয়েল মার্কেটের এক দোকানি নয়া দিগন্তকে বলেন, এমনিতেই দোকান ভাড়া, কর্মচারী বেতনসহ কিছু নির্ধারিত খরচ আমাদের প্রতি মাসেই আছে। তার ওপর দোকান খোলা রাখলে গুনতে হয় বাড়তি কিছু খরচ। দোকানে আসা-যাওয়ার পথে রাস্তার ঝুঁকি তো রয়েছেই। কিন্তু খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি সারা দিন বসে থেকে একটি টাকার পণ্যও বিক্রি করতে পারি না।
অবরোধের কারণে অনেক দোকান মালিক দেউলিয়া হওয়ার পথে দাবি করে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এস এ কাদের সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, অবরোধের কারণে দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতা আসছেন না।
সারা দেশে ২৫ লাখ দোকান আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২৫ লাখ দোকানে গড়ে তিনজন করে কর্মচারী ধরলেও দেশে মোট কর্মচারী আছেন ৭৫ লাখ। শ্রমিক ও মালিক মিলিয়ে এক কোটি পরিবার এসব দোকানের সাথে সরাসরি জড়িত। প্রতিটি পরিবারে চারজন করে ধরলে এসব দোকানের ওপর নির্ভর করছে চার কোটি মানুষের ভাগ্য।
তিনি বলেন, ২৫ লাখ দোকানে প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি হলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় তিন হাজার কোটি টাকা। বিক্রির ১০ শতাংশ লাভ ধরলে তার পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা। বর্তমানে দোকানে বিক্রি না হওয়ায় এ পরিমাণ লাভ হচ্ছে না। অন্য দিকে প্রতিদিন দোকান ভাড়া বাবদ গড়ে ১৫০ টাকা করে খরচ হচ্ছে। গুনতে হচ্ছে কর্মচারীর বেতনসহ অন্যান্য খরচ।

No comments

Powered by Blogger.