রাজনৈতিক স্থিতি পর্যটনের পূর্বশর্ত by সন্তোষ কুমার দেব ও মিসবাহ উদ্দিন সুমন

হরতাল-অবরোধে বিপর্যস্ত পর্যটন খাত। ২৮ জানুয়ারি সমকালে প্রকাশিত 'পর্যটন খাতে দুঃসময়' শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে তাই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। যেখানে সমকালের ভাষায় 'টানা হরতাল, অবরোধ ও নাশকতায় অভ্যন্তরীণ পর্যটন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কক্সবাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট কোথাও এখন পর্যটক নেই। ফলে এ খাতের সঙ্গে জড়িত অন্তত ১০ লাখ মানুষও সংকটে পড়েছেন।' যেখানে আমাদের পর্যটন সম্ভাবনাময়, সেখানে হঠাৎ এ ধরনের আঘাত কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এমনিতেই পর্যটন খাত নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই পার হয়ে কোনো ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই বলতে গেলে বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটন শিল্পের জন্ম হয়। মূলত চারটি বিষয় বেসরকারিভাবে পর্যটন শিল্পের এ বিকাশকে সফল করেছে বলা যায়। এগুলো হলো_ আতিথেয়তার জন্য হোটেল-রেস্টুরেন্ট, থাকার জন্য রিসোর্ট, থিম পার্ক এবং যাতায়াতের জন্য ট্রান্সপোর্ট সুবিধা। হরতাল-অবরোধের কারণে এসব বিষয়েই প্রভাব পড়েছে। অথচ এই সেক্টরের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক বিশাল উন্নতি সম্ভব। এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে জরুরি। একই সঙ্গে প্রয়োজন একটি সমন্বিত উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা। কিন্তু অতীতে কোনো সরকারই পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়নি। যদিও জনশক্তি রফতানি, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, পর্যটন খাতে সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বিষয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একটি চুক্তি ও তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা পর্যটন শিল্পের দ্রুত বর্ধনের জন্য প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। পর্যটন সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ফলে পর্যটন বিষয়ে গবেষণা, উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও পর্যটনভিত্তিক প্রচারণা বাড়বে। পার্শ্ববর্তী দেশ মালয়েশিয়া তাদের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোকে প্রমোট করে অর্থনীতিতে যে অবদান রাখছে কিন্তু আমরা সত্যিকার অর্থে সেভাবে পারছি না। তেলসমৃদ্ধ দেশ আরব আমিরাতও ট্যুরিজম উন্নয়নে নজর দিয়েছে। আমাদের দেশে ট্যুরিজম শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই আনবে না বরং সঠিকভাবে ট্যুরিজম স্পটগুলো খুঁজে বের করে একটি সমন্বিত উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার আওতায় নিয়ে এলে বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি শহরগুলোরও উন্নয়ন সম্ভব। এর আরেকটি পরোক্ষ সুফল পাওয়া যাবে, প্রধানত শহরমুখী জনস্রোতের চাপ কমবে।
এই পেরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ তার ট্যুরিস্ট স্পটগুলো নিয়ে ট্যুরিজম ডাটাবেজ তৈরি করতে পারে। সুন্দরবন, বান্দরবান, রাঙামাটি, কুয়াকাটা, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, বগুড়ার মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, বাগেরহাট ষাট গম্বুজ, কুমিল্লার ময়নামতি, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও সিলেটের জাফলং। নিঃসন্দেহে প্রাকৃতিক গুণাবলিতে এই স্পটগুলো সিঙ্গাপুর অথবা দুবাই থেকে অনেক উন্নত, এমনকি মালয়েশিয়ার অনেক স্থান থেকেও উন্নত। তবে ট্যুরিস্টদের মধ্যে কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন কোনায় যেখানে যেখানে যে যে ধরনের দর্শনীয়-শিক্ষণীয় ঐতিহাসিক স্থান আছে, তার একটা পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা জরুরি। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যটন ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে সেই স্থানের ঐতিহাসিক পটভূমিকাসহ এই ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। এই পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ একেবারে সম্পূর্ণ না হলেও নিয়মিত আপডেট করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশে পর্যটনের ওয়েবসাইটে এই তথ্যগুলো সনি্নবেশ করা অতি প্রয়োজন। তাছাড়াও অ্যাডিউজমেন্ট পার্ক ও রাইড স্থাপনার জন্য পাবলিক-প্রাইভেট কোম্পানি সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে। যদি দুই বা তিনটি শহরের মধ্যে বেশ কয়েকটি এ রকম ট্যুরিস্ট স্পট থাকে, তাহলে তাদের নিয়ে 'স্পেশাল ট্যুরিজম জোন' তৈরি করা যেতে পারে এবং সেই জোনে একটি স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা সম্ভব, এর জন্য নামকরা বিদেশি কোম্পানি যেমন_ রিসোর্ট ওয়ার্ল্ড অ্যাট গেনটিং (মালয়েশিয়া) ডেভেলপারের মতো কোনো কোম্পানির সঙ্গে পরামর্শ করতে পারে। এটা সত্যি যে, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক বড় বিনিয়োগ দরকার। আমাদের বিশ্বাস, এজন্য দেশের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসবে। আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র মালয়েশিয়া যদি পর্যটন শিল্পে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে বাংলাদেশ তার রূপবৈচিত্রের ছোঁয়ায় সবার মন আকর্ষণ করবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আমাদের প্রকৃতির রূপের সাগরে অবগাহন করবে। আর সেজন্য দরকার ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তাজনিত সন্তুষ্টি ট্যুরিজম শিল্প বিকাশে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তবে ইতিমধ্যে সরকার ট্যুরিস্ট পুলিশ ব্যবস্থা শুরু করেছে, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে ট্যুরিস্ট পুলিশদের সংখ্যা বাড়ানো ও পর্যটনবান্ধব মনোভাবের প্রয়োজন। উল্লেখ্য, পর্যটন শিল্প বিকাশে ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তার সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ এবং বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত। বর্তমান যুগে সবচেয়ে দ্রুত ও দরকারি তথ্য পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ওয়েবসাইট। ইন্টারনেটের যুগে সবাই প্রথমেই 'গুগল' সার্চ করে সংশ্লিষ্ট দেশের ট্যুরিজম সাইটগুলো দেখতে চায়। আমাদের কেন্দ্রীয়ভাবে ট্যুরিজমের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো 'বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড'। কিন্তু বিদেশিরা ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করবে 'ট্যুরিজম বাংলাদেশ' ধরনের শব্দ দিয়ে। সেক্ষেত্রে অনুসন্ধানে 'বাংলাদেশে ট্যুরিজম বোর্ডে'র ওয়েবসাইট দেখা যায়; কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব রয়েছে। তাই সরকারি এই ওয়েবসাইট মানসম্মত করার পাশাপাশি সব ধরনের তথ্য সংযোজন করতে হবে। পর্যটনের নিজস্ব থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের তথ্য বাদেও স্থানীয় পর্যায়ে বেসরকারি ব্যবস্থা আছে, সেই তথ্যগুলোও ওয়েবসাইটে সনি্নবেশ করা জরুরি।
এছাড়াও দেশি-বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করার জন্য ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্তি্বক স্থানগুলোর 'ভার্চুয়াল ট্যুরে'র ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কথায় বলে, লেখার থেকে ছবি বেশি তথ্য দেয়, তেমনিভাবে 'ভার্চুয়াল ট্যুর' ছবির থেকে বেশি তথ্যবহুল ও আবেদনময়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো স্থানে না গিয়েও কম্পিউটারের মাধ্যমে ওয়েবসাইট ওই স্থানকে ভার্চুয়ালি পরিদর্শন করা বা দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ 'গুগল স্ট্রিট ভিউ'র কথা বলা যেতে পারে। আমাদের দেশের কোনো এলাকা এখনও গুগলের ওই সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত না হলেও পৃথিবীর অনেক দেশের দর্শনীয় স্থানসহ রাস্তাঘাট ও পারিপাশর্ি্বক স্থানের নানামাত্রিক চিত্র সেখানে উল্লেখ রয়েছে। যে কোনো ব্যক্তি ওই 'গুগল স্ট্রিট ভিউ' ব্যবহার করে ওইসব স্থানে ঘুরে বা বেরিয়ে আসতে পারেন। এখানে বলা যেতে পারে, সিঙ্গাপুরের প্রায় সব স্থান গুগল স্ট্রিট ভিউ'র অন্তর্ভুক্ত।
দেশের ভেতর ছাড়াও বিদেশে আমাদের ট্যুরিজমের ব্যাপকভিত্তিক প্রচার চালানো দরকার। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি দুটি মাধ্যমকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মালয়েশিয়ার ট্যুরিজম নিয়ে রীতিমতো পোস্টার, লিফলেট দিয়ে প্রচার হয়, বাংলাদেশেরও উচিত মালয়েশিয়াকে অনুসরণ করা। এই খাত নিয়ে কোনো সরকারই ব্যাপকভিত্তিক স্টাডি করেনি। তবে আর পিছিয়ে থাকার সময় নেই। এই সেক্টরকে আগামীতে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
ট্যুরিজম নিয়ে তাই আর বসে থাকার সময় নেই। দেশের শহর ও অঞ্চল পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, গবেষক, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায়, দেশি-বিদেশি উৎসাহী ডেভেলপারদের সমন্বয়ে একটি মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে দেশব্যাপী একটি 'সমন্বিত ট্যুরিজম' শিল্প গড়ে তোলা। এতে যেমন দেশের অর্থনৈতিক আয়ের খাত তৈরি হবে, সে সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। বিশেষ করে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের শহরগুলো ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কক্সাবাজার, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা ইত্যাদি এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিয়মিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে ট্যুরিজম ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে যেমন শহরগুলোকে উন্নত করা যাবে, তেমনি স্থানীয়দের অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি স্বাবলম্বী ও সচ্ছল করা যাবে।
সম্প্রতি পর্যটন, আবাসন শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ, আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান খাতের অবদান নিয়ে চারটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতিবেদন অনুসারে অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান ১৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা।
দেশের পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে যে মূল্য সংযোজন হচ্ছে তার আকার মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) ৬.২৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ১৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা, পরিবহনসহ বিনোদন খাত থেকে এ মূল্য সংযোজন হয়েছে। এছাড়া জিডিপিতে শুধু পর্যটন খাতের অবদান রয়েছে ১.৫৬ শতাংশ। এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮ লাখ ১৫ হাজার। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১.৪১ শতাংশ, যা ২০২৩ সাল নাগাদ গড়ে যা ৬.৮ শতাংশে দাঁড়াত। টাকার অঙ্কে এটি প্রায় ৮১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
এ অবস্থায় এসে পর্যটন শিল্পের স্থবিরতা মেনে নেওয়া যায় না। পর্যটন শিল্পকে আরও আকর্ষণীয়, প্রাণবন্ত করে গড়ে তুলতে সরকারকে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করার চেয়ে এখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা জরুরি। দেশের অস্থিতিশীল অবস্থায় যেমন বিদেশ থেকে কোনো পর্যটক আসবে না, তেমনি দেশের মানুষও নিরাপত্তার কারণে কোথাও যেতে আগ্রহী হবে না।
সহকারী অধ্যাপক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.