‘কোকো কাহিনি’ বিভ্রান্তিকর by মাহবুব উদ্দিন খোকন

গত ৩০ জানুয়ারি শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের ‘কোকো কাহিনি’ শিরোনামে প্রথম আলোয় যে লেখা ছাপা হয়েছে, তা পড়লে যেকোনো পাঠকেরই বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে। কারণ, তাঁর লেখার ধরন খুবই সুন্দর। কিন্তু আমার কাছে জনাব ফেরদৌসের বেশির ভাগ বক্তব্য অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। হাসান ফেরদৌস লিখেছেন যে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে করা মার্কিন আদালতে জার্মানির মেসার্স সিমেন্স এজি ও চীনের চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য মামলা হয়েছে। সিমেন্স কোম্পানি মার্কিন আদালতে কোকোকে ঘুষ দেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। এই টাকার একটি অংশ  মার্কিন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে সিঙ্গাপুরে কোকোর অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে, যা জনাব ফেরদৌসের উল্লেখ করা ওয়েবসাইট ভ্রমণ করলে পাওয়া যাবে। তিনি আরও লিখেছেন যে আওয়ামী লীগ সরকার নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা মামলায় কোকোর সাজা হয়েছে। আমি কোকোর আইনজীবী হিসেবে নিম্নলিখিত কারণে দৃঢ়ভাবে বলছি যে হাসান ফেরদৌসের লিখিত বক্তব্য অসত্য, ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর।
১. প্রথমত, আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আদালতে কখনোই কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি বা জার্মানির সিমেন্স এজিও কোকোর সম্পর্কে মার্কিন আদালতে কোনো বক্তব্য পেশ করেনি, বা সিঙ্গাপুরে কোকোর কখনোই কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। সুতরাং জার্মানির সিমেন্স এজি কর্তৃক আমেরিকা থেকে সিঙ্গাপুরে কোকোর কথিত অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না।
২. হাসান ফেরদৌসের বক্তব্য অনুযায়ী, মার্কিন আদালতে ২০০৯ সালে সিমেন্সের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অথচ মার্কিন বিচার বিভাগের উপরোল্লিখিত ওয়েবসাইটে ২০০৮ সালে সিমেন্সের বিরুদ্ধে রায়ের কথা বলা হয়েছে। তাহলে মামলা আগে হয়েছে, না
রায় হয়েছে? এ ব্যাপারে হাসান ফেরদৌস সাহেবের বক্তব্য হাস্যকর। উল্লেখ্য, ওই ওয়েবসাইটের রায়ে কোকোর বিরুদ্ধে একটি শব্দও উল্লেখ নেই।
৩. হাসান ফেরদৌস লিখেছেন যে বাংলাদেশে কোকোর বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মামলা হয়েছে এবং সে মামলায় কোকোর সাজা হয়েছে। তাঁর এ বক্তব্য অসত্য। কারণ, ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কোকোকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অসুস্থ অবস্থায় ২০০৮ সালে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে যান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অসুস্থ আরাফাত রহমান কোকোর প্যারোল বাতিল করে এবং বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল চিরাচরিত নিয়ম ভঙ্গ করে নিম্ন আদালতে গিয়ে কোকোর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার আবেদন করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৭ মার্চ ২০০৯ তারিখে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে সাজা প্রদান করা হয়।
কোকোর আইনজীবী হিসেবে সবার অবগতির জন্য আমার বক্তব্য পেশ করছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও তিনবার নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় গত ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখ দুপুর সাড়ে ১২টায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর এই অকালমৃত্যুতে দেশবাসী গভীরভাবে শোকাহত।
আরাফাত রহমান কোকোকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাঁর মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দেশে তাঁদের ঢাকা সেনানিবাসের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সেনাসমর্থিত সরকার তাদের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নের জন্য খালেদা জিয়া ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে।
আরাফাত রহমান কোকো গ্রেপ্তারের পর গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হয় এবং পরবর্তীকালে ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই সুচিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দিয়ে ব্যাংককে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, আরাফাত রহমান কোকো দীর্ঘদিন ব্যাংককের প্রারাম ৯ হাসপাতালে (PRARAM 9 HOSPITAL) চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরবর্তীকালে ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাবশত গুরুতর অসুস্থ আরাফাত রহমান কোকোর প্যারোল বাতিল করে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে ১৭ মার্চ ২০০৯ তারিখে দুর্নীতি দমন কমিশন মানি লন্ডারিং আইনে কাফরুল থানায় মামলা নং ৩০(৩)২০০৯ দায়ের করে। দুদক কর্তৃক দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয় যে সিঙ্গাপুরের নাগরিক জনৈক মি. লিম সিউ চ্যাং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে গত ১০ এপ্রিল ২০০৪ তারিখে জেডএএসজেড ট্রেডিং অ্যান্ড কন্সাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করেন এবং ১২ এপ্রিল ২০০৪ তারিখে তিনি নিজেই সিঙ্গাপুরস্থ ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংক লিমিটেডের একটি শাখায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। আরও অভিযোগ করা হয় যে, পরবর্তী সময়ে আরাফাত রহমান কোকোর যৌথ স্বাক্ষরে ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন সময় টাকা লেনদেন হয় এবং অভিযোগ করা হয় সর্বশেষ ১৬ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৯,৩২,৬৭২.৮১ মার্কিন ডলার জমা হয়।
পরবর্তী সময়ে আরাফাত রহমান কোকো সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তাঁর অনুপস্থিতিতে সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতিরেকে সরকার দুদকের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ওই মামলা পরিচালনা করলে আদালতে রায় প্রদান করা হয়। এমনকি কোকোর স্বাক্ষর প্রমাণ করার জন্য সিঙ্গাপুরের ব্যাংক থেকে কেউ সাক্ষ্যও দেয়নি।
দুদক কর্তৃক দায়ের করা মামলার এজাহার থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে আরাফাত রহমান কোকো সিঙ্গাপুরের জেএএসজেড ট্রেডিং অ্যান্ড কন্সাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেড নামক কোম্পানির কোনো শেয়ারহোল্ডার কিংবা পরিচালক কখনোই ছিলেন না। ওই কোম্পানির নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও তিনি খোলেননি।
যদিও মামলার এজাহারে ১৬ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে টাকা লেনদেনের ব্যাপারে অভিযোগ করা হয়েছে, অথচ আরাফাত রহমান কোকো ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে কারাগারে আটক ছিলেন। তিনি জেলে থাকার সময় ১৬ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে সিঙ্গাপুরে কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়া অথবা কোকোর সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশে টাকা ফেরত আনার অভিযোগ হাস্যকর বটে।
তার পরও শুধু খালেদা জিয়া সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া কোকোর অনুপস্থিতিতে তাঁকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে।
আরাফাত রহমান কোকো সব সময় বলতেন, তাঁর মা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে এবং তিনি ভিকটিমাইজড হয়েছেন।
মাহবুব উদ্দিন খোকন: কোকোর আইনজীবী; সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ও চেয়ারম্যান, হিউম্যান রাইটস ও লিগ্যাল কমিটি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, রমনা, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.