প্রতি দু’দিনে একজন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার -অধিকার

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতি দুই দিনে একজন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। গত মাসে সারা দেশে মোট ১৭ জন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১২ জন, যার মধ্যে ৬ জন র‌্যাবের হাতে, ৫ জন পুলিশের হাতে ও একজন যৌথ বাহিনীর হাতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। নিহত অপর ৫ জনের মধ্যে ৪ জন পুলিশের গুলিতে ও একজনকে র‌্যাব পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গতকাল মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পাঠানো মাসিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৪৬ জন নিহত ও ১৯৪৬ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে হরতাল ও অবরোধের সময় পেট্রলবোমা হামলা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে ২০ জন নিহত ও ২৬০ জন আহত হয়েছেন। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৭ জন। গুম হয়েছেন ১৪ জন। তার মধ্যে ২ জনের লাশ পাওয়া গেলেও বাকিদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ জন। অধিকার জানায়, বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি ২০১১ সাল থেকে অভিযুক্তদের পায়ে গুলি করার একটি নতুন প্রবণতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। বর্তমানে বিরোধী দলের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই ধররে ঘটনা আরও বেশি ঘটছে। গত ৯ই জানুয়ারি ঢাকার শ্যামপুর ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিনকে পুলিশ বাসা থেকে ডেকে নিয়ে দুই পায়ে গুলি করেছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার। এছাড়া ১২ই জানুয়ারি ঢাকার আজমপুরে মুন্সী মার্কেটের সামনে ফায়েজ আলী নামে এক ব্যবসায়ীর কোমরে দক্ষিণখান থানার এসআই জয়নাল আবেদিন প্রকাশ্যে গুলি করেন। পরে পুলিশ প্রহরায় তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক ধরপাকড় ও গণগ্রেপ্তারের ফলে দেশের ৬৮টি কারাগারে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত বন্দি সামলাতে কারা কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারাগারগুলোতে ধারণ ক্ষমতা যেখানে ২৯ হাজার সেখানে বন্দি রয়েছে ৮০ হাজারেরও বেশি। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কারাগারগুলোর অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। ভুক্তভোগী বন্দিদের বরাত দিয়ে অধিকার জানিয়েছে, অতিরিক্ত বন্দির কারণে কারাগারে নেয়ার প্রথম ২-৩ দিন ঘুমানোর কোন সুযোগ পাওয়া যায় না। টাকা দিতে না পারলে কারারক্ষীরা খুবই নির্যাতন করে। প্রতিবাদ করলে নির্যাতনের পরিবার আরও বেড়ে যায়। প্রতিদিন ২ থেকে ৩শ’ বন্দি কারাগারে ঢুকছেন। বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। এছাড়া কারাগারের গেট থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বর্তমান সরকারের শাসনামলে গত বছরের ৫ই জানুয়ারি ও চলতি বছরের ৫ই জানুয়ারির আগে-পরে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অধিকারের সংগৃহীত তথ্য অনুয়ায়ী জানুয়ারি মাসে ৬ জন সাংবাদিক আহত, দুজন লাঞ্ছিত, একজন হুমকির সম্মুখীন ও ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুজনকে। অধিকার এর তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি মাসে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ ১ জন বাংলাদেশীকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এছাড়া বিএসএফ ১ জন বাংলাদেশী যুবককে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এবং পরবর্তীকালে তিনি ভারতীয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। জানুয়ারি মাসে মোট ১১ জন বিএসএফ-এর হাতে আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১০ জন গুলিতে এবং ১ জন নির্যাতনে আহত হন। একই সময়ে বিএসএফের হাতে অপহৃত হয়েছেন ৪ জন বাংলাদেশী। গত মাসে সারা দেশে ১২ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। অধিকার জানিয়েছে, ২০১৫ সালেও ব্যাপকভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। জানুয়ারি মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১৮ জন। ১৩ জন নারী যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে, ৩ জন বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার ও দুজন যৌতুকের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। গত মাসে ৯ জন এসডি সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৫ জন নারী, একজন পুরুষ, দুজন মেয়ে ও একজন বালক রয়েছেন। গত মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৯ জন নারী ও মেয়ে শিশু। অধিকার তাদের প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে, ৫ই জানুয়ারি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে জোর করে ক্ষমতায় থাকাই বর্তমান সঙ্কটের কারণ। যে কারণে সরকারের বৈধতা নিয়ে দেশ-বিদেশে সাংবিধানিক ও নৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এর আশু মীমাংসার জন্য সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অবিলম্বে একটি স্বচ্ছ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ইতিমধ্যেই ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দেশে আরও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি বন্ধে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে এবং সহিংসতার দায় একে অপরের ওপর চাপানোর সংস্কৃতি বন্ধ করে অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও শাস্তি দিতে হবে। অধিকার বলছে, বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হরতাল ও অবরোধ চলাকালে পেট্রলবোমা হামলা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সাধারণ নাগরিকরাই এই সমস্ত হামলার শিকার হচ্ছেন। যার কারণে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং অনেকেই চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। অধিকার মানবাধিকার সংগঠনসহ বাংলাদেশের নাগরিকদের এই ধরনের হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার আহবান জানাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.