একজন মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়টা রাতে না ভাঙলেই কি চলত না? by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
পিতা, আজ শতপর্ব পূর্ণ হলো। আশা করেছিলাম অনেক কিছু লিখব। কিন্তু হলো না। অস্বস্তি আর অশান্তির মধ্যে। আজ এসএসসি পরীা স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু বাচ্চাগুলো কবে নিরাপদে পরীক্ষা দিতে পারবে কেউ জানে না। দেশ জ্বলছে তো জ্বলছেই। এক দিকে তোমার কন্যা, অন্য দিকে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। ৩ তারিখ সরকারি অবরোধের শুরু, এখন বিএনপির অবরোধ। বিএনপি বলা বোধ হয় ঠিক হবে না। অবরোধটা এখন বেগম খালেদা জিয়া অথবা তার পুত্র লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের। এসব সহ্য করতে না পেরে ঘর ছেড়ে মতিঝিলের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছি। জায়গাটা তোমার চেনা। শেখ ফজলুল হক মনির বাংলার বাণীর উত্তর দরজার পাশে ফুটপাথে পড়ে আছি। ’৭৩ সালে ওখান থেকে একটু পশ্চিমে দু’তলা বা তিন তলায় ন্যাপের অফিস ছিল। যেখানে হুজুর মওলানা ভাসানী অনশন করেছিলেন। কোনো দেরি না করে তুমি ছুটে গিয়েছিলে, আমিও গিয়েছিলাম। অনেক বলে কয়ে সে দিনই অনশন ভাঙা হয়েছিল। আজকাল কেউ কারো খোঁজ রাখে না। পরম শত্র“ও কারো অত অকল্যাণ চায় না, যা এখন এক প্রতিদ্বন্দ্বী দল অন্য দলের জন্য চায়। মহাত্মা গান্ধী একটানা এক মাসের বেশি অনশন করেছেন, দু’চার দিন তো মাঝে মধ্যেই করতেন। হুজুর মওলানা ভাসানীও অনশন করতেন। আমাদের দেশে এখন প্রতীকী অনশন শুরু হয়েছে। সকাল ৮-৯টায় ভালোভাবে নাশতা খেয়ে প্রতীকী অনশনে বসে। ১২টা, না হয় ১টায় কেউ এসে ছবিটবি তুলে রসটস খাইয়ে প্রতীকী অনশন ভাঙে। আমরা তো এমনিই স্বাভাবিক নিয়মে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পরপর খাবার খাই। গ্রামের অনেক লোক তো পেটপুরে দুই বেলা খেতেই পায় না। মহাত্মা গান্ধী বা হুজুরের মতো লম্বা অনশন করতে না পারলে দুই-চার দিনের অনশন তো করা যায়। এমন কয়েক ঘণ্টার প্রতীকী অনশন করে লাভ কী? তবে পরে সাংবাদিক সত্য-মিথ্যা পে বলে, বিপরো সুযোগ পেলেই খোঁচা মারে। দেশের এই চরম নৈরাজ্য দেখে ঘরে থাকতে না পেরে রাস্তায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়েছি। দাবি খুব বেশি না, ওই যে বলেছি এসএসসি পরীা। আমি ভেবেছিলাম ৩০-৩৫ লাখ ছাত্রছাত্রী পরীায় বসবে। এক সাংবাদিক গত পরশু টিভি ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলেন। আমি ও রকম বলায় তিনি বললেন, সরকারি হিসাব ১৫ লাখ। আমি তো আর সরকার না, তাই সরকারি হিসাব জানি না। ১৫ লাখ হলে ১৫ লাখই সই। ছাত্রছাত্রী ১৫ লাখ, বাপ ১৫ লাখ, মা ১৫ লাখ, ভাই বা বোন থাকলে আরো ১৫ লাখ। দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, মামা-মামী কম-বেশি সবারই তো থাকে। সে জন্য কোটি মানুষ বাচ্চাগুলোর পরীার জন্য উৎকণ্ঠায়। তাই বেগম খালেদা জিয়ার কাছে নিবেদন করেছি, ছোট ছোট বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে অবরোধ বা হরতাল সাময়িকভাবে স্থগিত করুন। পরীা হোক তারপর না হয় একটানা ছয় মাসের অবরোধ বা হরতাল দেবেন। আমাদের হিসাবে ধরলে আমরাও না হয় আপনার পাশে দাঁড়াব। তাই দয়া করে অবরোধ প্রত্যাহার করুন, মানুষ বাঁচুক।
তোমার কন্যাকেও বলেছি, দেশের এই নৈরাজ্যের অবসানে আলোচনায় বসুন। তিনি বসবেন না, আলোচনা করবেন না। রাজনীতি তোমার কাছে শিখেছিলাম, তোমার গুরু মওলানা ভাসানীর কাছে দু’এক কথা শুনেছিলাম। দেশের দায়িত্ব নিয়ে অমন ছাগলের খুঁটি ধরে বসে থাকা যায়? দেশের জন্য তো উন্নাসিকতা থাকা উচিত না। দেশের কল্যাণে প্রয়োজনে চাঁড়ালের সাথেও কথা বলতে গর্ববোধ করবেন- সেটাই দেশসেবা। তাই তাকে আলোচনায় বসতে অনুরোধ করেছি। আজ ছয় দিন আকাশের নিচে শুধু একটা কাপড় টাঙিয়ে শুয়ে বসে দিন-রাত এক করছিÑ সমাজপতিদের কোনো চার নেই। কিন্তু বড় ভালো লাগে, যখন কোনো রিকশাওয়ালা এসে বলে, এর মধ্যে থাকা যায়? এত কষ্ট করছেন? সে দিন বড় বিস্মিত হয়েছি। মুখ ধুতে সরেছিলাম, কয়েকজন পুলিশ এসে বলছিল, স্যার, এত কষ্ট করে কিভাবে থাকেন? আপনারা দেখবেন স্যারের যাতে কষ্ট না হয়। সামান্য চটের পর্দার উল্টো পাশ থেকে কথাগুলো শুনে বুক ভরে গিয়েছিল। ছোটকালে অনেক ব্যথা নিয়ে মার কাছে গেলে মা সান্ত্বনা দিলে যেমন লাগত, মাঝেসাজে তেমন লাগে। তোমার এই মেয়ে বড় ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে মায়ের মতো যতœ করতেন। কিন্তু এখন কেন যে এমন হলেন বুঝতে পারি না। আমার সাথে কথা বলতে না চান, না বলবেন। রেহানা যখন ভাই বলে উতলা হয় তখন সব বঞ্চনা আপনাআপনিই তুচ্ছ হয়ে যায়। সেই তোমার মেয়ে কেন মানুষের কাছে ছোট হবেন, কেন তিনি ছোট কাজ করবেন? জানি না, তুমি থাকলে কী করতে, কী বলতে।
প্রধান বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার অফিস, বাড়ির বিদ্যুৎ, পানি বন্ধ করে দিয়েছে, ইন্টারনেট চলছে না, টেলিফোন বন্ধÑ এগুলো করা কি ভালো? এসব করে কি কেউ খুব বেশি লাভবান হয়েছে? কিন্তু কেন যে তারা করছে কিছুই বুঝতে পারি না। তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেছে যারা, তোমার চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়েছে যারা সেই বেগম মতিয়া চৌধুরী, সেই হাসানুল হক ইনু বলছে, কোনো আলোচনা নয়, রাস্তায়ই ফয়সালা হবে। তোমার সরকার উৎখাত করতে, তোমাকে ধ্বংস করতে এক সময় কত কিছুই না করেছে। এখন তোমার মেয়ের সরকারে তারা মস্ত একটা কিছু। তাদের কথাবার্তায় টেকা যায় না। এরা নৌকার ছায়া না পেলে কিয়ামত পর্যন্ত সংসদের দিকে তাকাতেও পারতেন নাÑ সেই তাদের অমন আস্ফালন সহ্য করা যায়? কিন্তু জনাব তোফায়েল আহমেদ, যাকে আজীবন সম্মান করেছি, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক হিসেবে সব সময় মাথায় রেখেছি। কিন্তু সে দিন তিনি কী বললেন, মানুষ জ্ঞানহারা হলে যেমন বলে তেমন বলেছেন।
তুমি তো জানো না, ২৪ জানুয়ারি বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো বিদেশ বিভুঁইয়ের মালয়েশিয়ায় ইন্তেকাল করেছে। লাশ দেশে আনা হয় মঙ্গলবার। এক অসাধারণ বিশাল নামাজে জানাজা হয়েছে। তোমার স্বাভাবিক মৃত্যু হলে নামাজে জানাজায় কোনো মাঠে জায়গা হতো কি না ভেবে পাই না। কিন্তু দেখো কী কপাল! টুঙ্গিপাড়ায় অনাদরে তোমার নামাজে জানাজায় ১৭-১৮ জন লোক হয়েছিল, আমার নামাজে জানাজায় তাও হবে কি না বলতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীতে ৭২ হাজার সাহায্যকারী, আর ১৮ হাজার প্রত্য যোদ্ধা ছিল। জিয়াউর রহমানের ‘জেড’ ফোর্সে দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৬০০ সৈন্য ছিল। তোমার মতো জিয়াউর রহমানও চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের কোনো পাহাড়ের পাদদেশে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে ঢাকায় এনে দাফন করা হয়। সেই শোকমিছিল এবং নামাজে জানাজায় স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম হয়েছিল। আবার এই সে দিন মঙ্গলবার তার ছেলের নামাজে জানাজা হয়েছে বায়তুল মোকাররমে। একজন মুসলমান হিসেবে শরিক হয়েছিলাম। এখন বায়তুল মোকাররমের খতিব অধ্যাপক সালাহউদ্দিন।
জিগাতলার মহসীন বুলবুল ভাইর বন্ধু। খুবই অমায়িক মানুষ। আমাকে ভীষণ সম্মান করেন, তাই আমিও সম্মান না করে পারি না। একেবারে তার কাছাকাছি প্রথম কাতারে নামাজে জানাজায় ছিলাম। আমি যতটা গোনাগুনতি জানি তাতে লোকসংখ্যা গুনে শেষ করতে পারিনি। দেখো, কোকো কোনো রাজনীতি করেনি। কিন্তু তার সে কী বিশাল নামাজে জানাজা। কেন অমন হলো? মানুষ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় রয়েছে। সরকার বিরোধী কাউকে রাস্তায় নামতে দেয় না। এই সরকারের কর্মকাণ্ড স্বৈরাচারকেও হার মানায়। এই এক মাসে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবের কর্মকর্তারা রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও জঘন্য অরাজনৈতিক কথা বলেছেন যার জন্য বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু তারা হয়তো প্রশংসা পেয়েছে। তাই তোমাকে সুসংবাদ দেয়ার তেমন বেশি কিছু নেই। যা কিছু বলতে চাই তার সবকিছু কিছুটা দুঃসংবাদের মতোই শুনাবে। যখন অত বিপুল লোকসংখ্যার নামাজে জানাজা নিয়ে কথা হয়, তখন তোমার এক সময়ের রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে এই দীর্ঘ অবরোধে অনেক মানুষ মারা গেছে। বিরোধী দলের আক্রমণেও মারা গেছে অথবা বিরোধী দল বলে সরকারি এজেন্টরা মেরে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপিয়েছে। কিন্তু লোক মারা গেছে। তাই প্রবীণ রাজনীতিবিদ বলেছেন, যেহেতু আন্দোলনের নামে বেগম খালেদা জিয়া মানুষ মারছে, তাতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে। সেই জন্য তার ছেলে মারা গেছে। এমন বিশ্রী কথা এমন নি¤œমানের চিন্তা কেউ করে? আমি কিন্তু এটাকে জনাব তোফায়েল আহমেদের কথা বলে মনে করি না, আমি এটাকে আওয়ামী লীগের কথা বলেই মনে করি। যেমন কয়েক মাস আগে আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী রাসূল ও হজ সম্পর্কে বলেছিলেন। যারা সারাজীবন আওয়ামী লীগের কথা বলে তারা এক দিনে কী করে নিজের কথা বলবে? তাই আল্লাহর কাছে উভয় নেত্রীর শুভ বুদ্ধি কামনায় রাস্তায় পড়ে আছি।
অনেক দিন পর গত শুক্রবার বায়তুল মোকাররমে নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলাম। বড় জামাতে জুমার নামাজ পড়তে বেশ ভালো লাগে। কেন যে মানুষ এত সম্মান দেখায়, জানি না। এ জন ও জন টানতে টানতে প্রথম সারিতে নিয়ে গিয়েছিল। মনে হয় সে দিন আওয়ামী লীগের গায়েবানা নামাজে জানাজা ছিল। জনাব তোফায়েল আহমেদ একটু দূরে গেটের কাছে ছিলেন। কিন্তু জনাব আমীর হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সবাই হাত বাড়িয়েছিলেন মুসাফার জন্য। পেশ ইমাম অধ্যাপক সালাউদ্দিন বাংলায় খুতবা দিয়েছিলেন। সে দিন ছিল বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী র: জন্মদিন। তিনিও তার নরম হাত এগিয়ে দিয়েছিলেন। বড় ভালো লেগেছে। প্রথমে জনাব রাশেদ খান মেননের বামে বসেছিলাম। পরে মনে হলোÑ না, আরেকটু ডানে বসি। বামপন্থী রাশেদ খান মেননকে বামে ফেলে প্রবীণ নেতা আমীর হোসেন আমুকে ডানে নিয়ে বসেছিলাম। জনাব আমীর হোসেন আমু আমায় আগাগোড়াই যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখেন। আমিও তাকে ভালোবাসি, সম্মান করি। তার প্রয়াত স্ত্রী আমার যে অসাধারণ যতœ নিয়েছেন যা শুধু একমাত্র মা অথবা বোনেরাই ভাইকে নিতে পারে। ডানে আমীর হোসেন আমু, বামে বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননের মাঝে বসে মনের মধ্যে নানা কিছু উথালপাথাল করছিল। তোমার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা কত বড় সফল নেতা, বামপন্থী নাস্তিক নেতাকেও মসজিদে পাঠিয়েছেন। তোমার কথা বলতে বলতে এখন তারা মুখে ফেনা তোলেÑ এটা কি সত্যিই সফলতা নয়? অবশ্যই এক বিস্ময়কর সাফল্য। গত পরশু বিকেলে এক ভদ্রলোকের কথায় বড় হোঁচট খেয়েছি। বছর দুই-আড়াই আগে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে এক বৈঠকে দুই-তিনবার জননেত্রী বলায় তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, জনগণকে যিনি এত বঞ্চিত করছেন, নিপীড়ন করছেন তাকে আপনি জননেত্রী বলে সম্বোধন করেন? বলেছিলাম, এটাই আমার দোষ। ছোটকেও বড় বলতে আমার বিবেক কখনো বাধা দেয় না। কিন্তু পরশু একজন বলছিল, টিভিতে আপনার বক্তব্য শুনলাম। আপনি বেগম খালেদা জিয়াকে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন। গত ৫ জানুয়ারি ভোটার ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন জোর জবরদস্তি করে সরকারে যাওয়ার পরও তিনি জননেত্রী বা জনগণের নেত্রী? আসলে লোকটির কথার কোনো জবাব দিতে পারিনি। আসলেই একজন জননেতার মানুষের হৃদয়ে যে অবস্থান থাকে, বর্তমান জননেত্রী শেখ হাসিনার সে অবস্থান নেই।
দুই নেত্রীর শুভ বুদ্ধি উদয়ের আশায় আজ ছয় দিন রাস্তায় পড়ে আছি। আমার অবস্থানের ১০ গজ পশ্চিমে শেখ মনি ভাইর ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপসের বাংলার বাণী অফিস। সেই অফিসের ভাঙা চেয়ার-টেবিলের হেফাজতে দিনরাত ছয়জন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু আমি যে একজন জীবন্ত মানুষ রাস্তায় পড়ে আছি, আমাদেরও যে সামান্য নিরাপত্তার কথা রাষ্ট্রের চিন্তা করা উচিত তার কোনো আলামত দেখিনি এ ক’দিন। লেখার আগের অংশটুকু একটু আগে লিখেছিলাম, শেষের এ অংশ এখন লিখছি। এই ছয় দিনে কত পুলিশ, মতিঝিলের অফিসের কত পাহারাদার কতভাবে বলেছে, এভাবে রাস্তার পাশে পড়ে আছেন, কষ্ট হয় না? সত্যিই তাদের কথায় কষ্ট তো হয়নিই বরং আনন্দ পেয়েছি। শুক্রবার মসজিদেও মাননীয় মন্ত্রী আমীর হোসেন আমু জিজ্ঞেস করছিলেন, এই ঠাণ্ডায় রাস্তায় পড়ে আছেন শরীর খারাপ করবে না তো? রাশেদ খান মেননও জিজ্ঞেস করেছেন, রাস্তার পাড়ে থাকেন কিভাবে? বলেছিলাম, কপাল! শনিবার বিকেলে দীপ কুশিকে নিয়ে ওর মা নাসরীন এসেছিল। শুক্রবার তেমন কিছু বলেনি। কী করে যেন শনিবার আমার গা ঘেঁষে কানে কানে বলছিল, আব্বু, তোমার কাপড়ের ঘর খুব ভালো হয়েছে। ফুপি আবার রাগ করে ছিঁড়ে দেবে না তো? আমি চমকে উঠেছিলাম, কী বলে আমার ছোট্ট মামণি! এ পাঁচ দিনে একবারও কথাটা মনে হয়নি। আমি জানি আমার ব্যাপারে পানের বোঁটায় একটু চুন লাগলে সেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতে আমার ব্যাপারে কিছু হয় বলে বিশ্বাস করি না। আমাকে খুন করা হলেও আমার মনে হবে ব্যাপারটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন। নিষ্পাপ শিশুরা যেসব জানে তা পরশুর ঘটনা থেকে আরো স্পষ্ট হলো। রাত ১১টার দিকে হঠাৎই পুলিশের আগমন। অফিস টাইমে পিলারে মাইক বেঁধে বাজালে লোকজনের অসুবিধা হবে। তবে গতকাল গাড়ির ওপরে যে মাইক ছিল তাতে কোনো অসুবিধা নেই। ফুটপাথের ওপর থাকতে পারেন, রাস্তার ওপর চেয়ার নিয়ে বসতে পারেন কিন্তু কাপড় টাঙানো যাবে না, ভেঙে ফেলতে হবে। একজন খুব অমায়িকভাবে বলছিলেন, আরেকজন বোধ হয় ওসি হবেন। কেউ বলছিল গোপালগঞ্জে বাড়ি। আমি তো চিনি না তাই নিশ্চিত করে বলতে পারি না। যেখানেই হোক বলেছিলাম, আচ্ছা দেখব। একজন বললেন, আপনার কথা আমরা বিশ্বাস করি। মনে হয় ওসি হবেÑ একেবারে চাঁড়ালের মতো বললেন, আপনারা নিজে ভাঙবেন, না আমরা ভেঙে ফেলব? আবারো বললাম, ঠিক আছে। সকাল হোক লোকজন আসুক। যারা বানিয়েছে তাদের বলে কয়ে মনে হয় একটা কিছু করা যাবে। আর আমরা তো সকাল হলেই ঘেরাও খুলে ফেলব। আপনাদের কথায় যদি ওপরেরটা খুলতে হয়, তাতে যদি শান্তি হয় করব। আমার ঠাণ্ডার দোষ আছে। বাতাস সইতে পারি না। রাতটা ওভাবেই যাক। সারা দিনে দু’চোখ এক করতে পারিনি। তাই শুতে শুতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অমন মরণঘুম আমার খুব একটা হয় না। হু হু বাতাসে ঘুম ভেঙে দেখি, শীতের রাতে মাথার ওপর কাপড়ের ছায়া অনেকটা ভেঙে ফেলেছে। কখন ভেঙেছে কিছুই বুঝতে পারিনি। গলা ও বুকটা ভার নিয়ে কিছুটা অসুস্থ শরীরে ঘুম থেকে উঠেছি। মনে কত প্রশ্ন জাগে, তোমার মেয়ের যখন দুঃসময় ছিল আমি তখন তার পাশেই ছিলাম। তিনি জানতেন আমার ঠাণ্ডার দোষ আছে। দিল্লিতে কতবার হাত-পায়ে লাগানোর জন্য চুন-তেল গরম করে দিয়েছেন। কত নির্বাচনী সভায় গিয়ে খাবার না খেয়ে আমার জন্য বসে থেকেছেন। সেই মায়ের মতো বোন আমি ঠাণ্ডায় কষ্ট পাই এটা জানার পরও আমার মাথার ওপর থেকে কাপড়ের ছায়া খুলে নিতে বলবেন? আর তাকে না জানিয়ে এমনটা কোনো অতি উৎসাহী কর্মকর্তা করতে পারে তাই-বা বিশ্বাস করি কী করে? কর্মীরা সকালে বলেছে, কোনো এক সাবইন্সপেক্টর নাকি বলেছেÑ স্যার, গুলি করে দিই? বড় অবাক লাগে, সে দিন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অফিসে গিয়েছিলাম। কী যে অসাধারণ যতœ নিয়েছেন অভিভূত না হয়ে পারিনি। তাদের পুলিশ তো সকাল পর্যন্ত অপো করতে পারত। তাতে হয়তো আমার ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়া হওয়ার ভয় থাকত না। নিউমোনিয়ার চেয়েও আমার বড় ভয় আমার কলিজার টুকরা কুশিমণিকে কী জবাব দেবো? সে কী করে মাত্র দুই-তিন ঘণ্টা আগে বলে গেল, ফুপি তো আবার তোমার কাপড়ের ঘর ছিঁড়ে দেবে না? তার ফুপি মানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। কোনো জবাব নেই। দেশের মানুষের চিন্তায় ভালো লাগে না। বিরোধীদলীয় নেত্রীর আহ্বানে হরতাল চলছে। ঢাকা শহরে দেদার গাড়ি ঘোড়া চলছে। কিন্তু মফস্বলে তেমন নয়। তোমাকে আজ থেকে লেখা বন্ধ হলো। তার অর্থ এই নয়, বুকের কপাট বন্ধ হলো। তোমাকে দেখেই জননী, জন্মভূমিকে চিনেছি। ঘরকুনে লাজুক সন্তান, কুয়োর ব্যাঙ বিশ্ব জানার চেষ্টা করেছি, তোমার দরদে দরদি হতে চেয়েছি, জাতির বেদনায় কান্না, আনন্দে হাসতে শিখেছি। তাই তুমি আমার চেতনা, তুমিই আমার সব। তোমার রাজনৈতিক আদর্শের সাথে ছিলাম, আছি এবং থাকব ততণ যতণ ভবে আছি।

No comments

Powered by Blogger.