দোহাই, বিচলিত হবেন না by রওশন আরা লীনা

তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা; তার রাজনীতি,
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার পলে পলে মনুষ্যমণ্ডলী, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন করে আমাকে পীড়ন করো না;
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না; তার অনেক কারণ রয়েছে।
বাংলাদেশের কথা : হুমায়ুন আজাদ

বাংলাদেশে আবারও মানুষ মারা শুরু হয়েছে এবং যেহেতু মানুষগুলো মানুষ নয় তাই তাদের মৃত্যু খুব গুরুত্বের দাবি রাখে না। মানুষগুলোকে বরং জনগণ ও আমরা না বলি; কারণ বাংলাদেশে জনগণও বড় ভয়াবহ ব্যাপার। পেটে ভাত বা পরনে কাপড় না থাকলেও জনগণ বদলে দিতে পারে অনেক কিছু। কখনও প্রবল প্রতিরোধে ফুঁসে উঠতে পারে সদর্পে। সুতরাং মানুষগুলো জনগণ ও নয় ওরা ক্রমভারাক্রান্ত হয়ে ওঠা পৃথিবীর বিরাট লোকসংখ্যার এক মামুলি লোক, যাদের জন্ম বা মৃত্যু কোনোটাই কারও বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে না। দশকে দশকে লোক মরছে। চার, পাঁচ বছরে লোক মরেছে। বছরে বছরে লোক মরেছে। সুতরাং এরা কোনো দিনই বিশেষ মনোযোগ পাওয়ার দাবিদার নয়। এরা সবাই লোক, মানুষ নয়। বাঙালির ইতিহাসে নানা গৌরবোজ্জ্বল দিন বা তাদের গৌরবগাথার সঙ্গে এদের ইতিহাস কখনোই গাঁথা হবে না।
বায়ান্নর সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার অথবা একাত্তরের মা, ভাইবোন কিংবা আরও আগে যদি দেখি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিকে ইতিহাস নিয়ে আমরা আজও বুকের ভেতর সমাধি গড়ে অশ্রুসজল হয়ে উঠি। শহীদ মিনারে_ 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো' গেয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করি। জাতীয় দিবসে কুচকাওয়াজ, সরকারি ছুটি, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণ, গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তিদের জাতির উদ্দেশে বাণী প্রদান, মসজিদে মসজিদে নামাজ। মন্দিরে মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা, এতিমখানা, জেলখানায় বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা, পাড়ার মোড়ে মোড়ে দলীয় কার্যালয় বা ক্লাবে বিশেষ খিচুড়ি বিতরণের ব্যবস্থা করতে পারি আমরা। এসব আয়োজনই মানুষের জন্য মানুষের প্রচেষ্টা। বইমেলার ফিতা কেটে অথবা বিদেশি ব্যাংকের উদ্বোধনে অনায়াসে যা নিয়ে আলোচনা করলে একটুও বিপদের আশঙ্কা থাকে না। যা নিয়ে হাজারবার আলোচনা করলেও জাতির মুখস্থ হলেও তাতে বিপদ বা বধিরতার আশঙ্কা থাকে না। সেসব এতিহ্যমণ্ডিত মানুষের মৃত্যুগুলো আমরা অবশ্যই স্মরণে রাখি; কিন্তু এই লোকেরা যেন মানুষ নয়। তাই লোকেরা শহীদ মিনার, রাষ্ট্রায়ত্ত দিন, মন্দির-মসজিদে প্রার্থনা বা নূ্যনতম মনোযোগী পাওয়ার দাবিদার নয়। খুব বেশি ভাগ্যবান হলে তারা জাতীয় দৈনিকের পাতায় একটি সংখ্যা হয়ে উঠতে পারে।
বরং এমন করে দেখা যেতেই পারে যে, ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে মানুষের ভালোভাবে বাঁচার জন্য দশকে দশকে, বছরে কিছু লোকসংখ্যা কমিয়ে ফেলতেই হবে। কারণ আগাছা বেড়ে গেলে যেমন শৌখিন গাছ বাড়তে পারে না তেমনি সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ যাই-ই হোক না কেন, তা বিষয় নয়। আমরা বরং বুঝতে চেষ্টা করি লোকের সংখ্যা বেড়ে গেলে মানুষের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। তাই আট মাস থেকে আশি বছর বয়সী পেট্রোল বোমায় পোড়া লোকেদের নিয়ে আমরা একদম ভাবব না। তাদের পরিবারগুলোর বুকে জন্ম নেওয়া অনন্ত রাত্রির কাফনের কালির কথা আমরা ভাবব না। যে পিতা তার শিশুসন্তানকে শহর দেখাতে এনে অসহায় চোখে বাসের ভেতর পুড়তে থাকা সন্তানের গলিত লাশ দেখেছেন তার বুকের শহীদ মিনারে আমরা মালা দেব না। যে কুলসুম দিনের পর দিন গার্মেন্ট বন্ধ থাকায় অবশেষে শরীর পেতে দিয়েছে কোনো ঝুপড়ির তলায় তার গ্গ্নানির লজ্জা আমরা দেখব না। যে মা চাল কিনতে না পেরে একমাত্র সন্তানকে মাত্র ষাট টাকা রোজ ঠিক করে মিছিলে পিকেটিংয়ের জন্য পাঠিয়েছিলেন এবং মধ্যদিনে চালের আশ্বাসের বদলে জ্বলন্ত শিশুকে খুঁজে পেয়েছেন চুলার আগুনের পাশে আমরা তার কথা একদম ভাবব না। একদম না, কারণ এরা সকলেই লোক। তারা কেউ মানুষ নয়। তাই এদের নিয়ে কোনো কাব্যে কোথাও লেখা হবে না_ তুমি আসবে বলে হে বাস্তবতা...
এরা যত্রতত্র জন্ম নেয় আবার বোকার মতো যত্রতত্র মরে যায়। এদের মৃত্যুর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমাদের একজন মানুষের বেঁচে থাকা, তাদের স্বার্থ ও সুবিধা। রাষ্ট্রীয় আয়, প্রবৃদ্ধি, হরতালে একদিনের আর্থিক ক্ষতি, আসন্ন বসন্ত উৎসব, কবিতা উৎসব, আন্তর্জাতিক সম্মেলন, হজ ও ওমরাহ পালন ইত্যাদি আমাদের কাছে আরও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণর্। কারণ লোকেরা তো সত্যিই মানুষ নয়। তাই লোকেদের পিটিয়ে লাশ করে ফেললেও আমরা মহানন্দে সেই দৃশ্য দেখে টিভির রিমোট টিপে দিই অন্য চ্যানেলের। মানুষ আমাদের কারও মা, বাবা, ভাই মরেছেন। কারও মরেছেন স্বামী। কাজেই তাদের জন্য আমরা শোক পালন করি, সভা-সমিতি করি, কিন্তু লোকেরা কারও মা, ভাই, বোন বা স্বামী নন। কাজেই তাদের নামে দিবস, শোক বা কোনো শোকবার্তা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। লোকেরা রোদে, জলে ভিজবে, পশুর মতো বাঁচবে, কুকুরের মতো মরবে, এই-ই সত্যি। তাদের জন্য শোকের কী আছে? বরং দশকে দশকে বাঙালির ভাগ্যবদলের জন্য, দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এ রকম আরও অনেক লোকের চিতাভস্ম প্রয়োজন, তবেই না আমরা জনদরদি, গণদরদি নেতা হয়ে উঠতে পারব। গালভরা বক্তব্যে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিতে পারব মানুষের জন্য। আমরা ওইসব লোকের কথা বলব না, ওদের জন্য কোনো শোক প্রস্তাব রাখব না। কারণ তুচ্ছ লোকেদের মৃত্যুর বিচার চেয়ে শোক করতে গেলে বাংলাদেশে শুধু নয়, পৃথিবীর কোনো আদালত এই বিচার শেষ করতে পারবে কিনা আমার তাতে সন্দেহ আছে। আমরা দিবস পালন করতে বসি, তবে বাংলাদেশে শোক দিবস ছাড়া কোনো কর্মদিবস থাকবে কিনা তা নিয়েও আমার সংশয় রয়েছে। বরং এত মৃত্যু, এত বলিদানের পরও আমরা নিজেরাই বেঁচে আছি কিনা তা নিয়ে আজ সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। দোহাই আপনাদের! বন্ধুগণ আপনারা বিচলিত হবেন না। বিচলিত হওয়ার মতো এখনও কোনো ঘটনা ঘটেনি। জাতির বিরাট ভাগ্যবদলের বিশাল কর্মযজ্ঞে কয়েকটা পতঙ্গের মৃত্যু ঘটবে তাতে কী-ইবা যায় আসে! পরিবর্তনটাই আসল কথা। কাজেই আসুন সকালের চায়ের কাপে আয়েশ করে একটা চুমুক দিই আর দেখি আমাদের এই পরিবর্তনে বেকার, ফালতু আর ক'টি লোক অথবা শিশু পুড়ল? অনেকটা আজকের বাজারদর বা শেয়ার মার্কেটের খবর জানবার মতো। কারণ বেঁচে আছি বলেই এখনও আপনি আমি মানুষ হয়ে আছি। পুড়ে গিয়ে লোকে রূপান্তরিত হইনি।
গবেষক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

No comments

Powered by Blogger.