একটি শান্তি-সমঝোতা স্মারকের খসড়া by তোফায়েল আহমেদ

সারা দেশ যেন জ্বলছে। জ্বলছে শিশু, নারী, শ্রমজীবী ও পান্থজন। পুড়ছে মানুষের শরীর-মন-বিবেক-মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা। ভয়াল এক বিভীষিকার চাদরে আবৃত সারা দেশ। সরকার অনড়, অবিচল বিরোধী দল; বিস্মিত, বিচলিত ও বিমূঢ় জনগণ। মানুষ এখন কোনটা বেছে নেবে? ফুটন্ত কড়াই, না জ্বলন্ত উনুন? কিছু বাচাল প্রকৃতির মানুষ, নেতা-মন্ত্রী অবিরাম অনর্গল কথা বলে অসুস্থতা ও অস্থিরতা আরও বাড়াচ্ছেন। বিরোধী জোট নীরব, কিন্তু সক্রিয়। স্বীকার-অস্বীকারের মধ্যে চলছে দহন-পীড়ন। গাড়িদাহ ও নিরীহ যাত্রীদাহ নিত্যদিনের ঘটনা।
কোথাও যেন মাতৃশোক, পিতৃশোক, ভ্রাতৃশোক, ভগ্নিশোক, পুত্র-কন্যার শোক কিছুই নেই। যে যার গন্তব্যে ভ্রুক্ষেপহীন-ভাবলেশহীন। আছে শুধু যেন ক্ষমতার সুখ ও শখ। পুলিশ-বিজিবিসহ মাঠে থাকা বাহিনীগুলোর নানা কাহিনি আসছে গণমাধ্যমে। তারা বক্তব্যে বেপরোয়া, কিন্তু কর্তব্যে ব্যর্থতার গ্লানি।
সারা বিশ্ব দেখছে আমাদের ‘আঙ্গু’-‘বাঙ্গু’দের পরস্পরকে শেষ করে দেওয়ার অশেষ হিংসা ও ঘৃণার বেসাতি। আফগানিস্তান, ইরাক, সুদান, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, মিসর, বসনিয়া, চেচনিয়া অনেকের যুদ্ধ, বিরোধ ও শান্তির ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু আমাদের শান্তি-সোনার স্বপ্নের এ দেশে ভিন্নরূপে এ অশান্তি ঝেঁকে বসবে, তা কখনো ভাবিনি। লেবানন বা ফিলিস্তিনের মানুষ ঘৃণা-হিংসা, যুদ্ধ ও অশান্তির মাঝে জীবনযাপনের একটি দীর্ঘস্থায়ী অস্বাভাবিকতাকে ‘স্বাভাবিক’ ধরে যুগ-যুগান্তর পার করছে। আমরাও স্বাধীনতার ৪৪ বছরের মধ্যে ১০টি বছর কখনো নিরবচ্ছিন্ন স্বাভাবিকতা, শান্তি ও স্বস্তির স্বাদ পেলাম না। শান্তি ও স্বস্তি কি আমাদের রক্তে নেই?
এই রোদ তো, এই ঈশান কোণে কালো মেঘ। এই বৃষ্টি তো, এই ঝড়। এই মাত্র সংগীত তো, অন্য প্রান্তে ভয়ার্ত চিৎকার। ভিন্নমতের বিতর্ক এখানে অভাবিত। বিভেদ, ঘৃণা, হিংসা, বিভ্রান্তিই যেন আমাদের অমোঘ নিয়তি। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশের সবার ভাগ্য কয়েক লাখ অবিমৃশ্যকারীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে। দুই নেত্রী আর তাঁদের পেছনে দুই দঙ্গল সৃজনশীলতা, সৎসাহস ও সৎ উদ্যোগ রহিত অনুসারী। সভ্যতাবিনাশী সর্বনাশা অরাজকতার নাম রাজনীতি নয়। কোটি মানুষের নীরবতাই এ অবস্থার প্রধান ইন্ধন ও অবলম্বন। এ নীরবতা রাজনীতিকে আরও অসুস্থ করছে। এ অসুস্থতা ও ব্যাধির নাম দুরারোগ্য ক্ষমতা রোগ। সারা জাতিকে এ ব্যাধির সংক্রমণে বাধ্য করা হচ্ছে। আমরা আর অসুস্থ হতে চাই না। আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র চাই। আমরা স্বাধীন জীবন-জীবিকা, স্বাধীন চলাফেরা ও স্বাধীনভাবে কথা বলতে চাই। আমরা চাই নির্মল বায়ু, নিরাপদ খাবার ও পানীয়। একে অন্যের সহায়তা ও সহানুভূতি। চাই ভালোবাসা এবং ভালোবাসতে। ঘৃণা ও হিংসার বেসাতি চাই না। আমরা শান্তি চাই।
কেউ আছে আক্রমণে, কেউ প্রতি-আক্রমণে। চিন্তা-চেতনাহীন নির্লিপ্ততার সঙ্গে নিজের অজান্তেই তারা ভয়ংকর আত্মবিনাশী যুদ্ধে লিপ্ত। কোনো কোনো বিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ নাগরিক বলছেন, দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবমান। কেউ বলছেন, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ যুদ্ধ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। কেউ বলছেন, আপনারা এখন ‘যুদ্ধবিরতিতে’ আসুন। নিজেরা বাঁচুন, দেশ ও সমাজকে বাঁচান। ‘যুদ্ধ’ বা ‘গৃহযুদ্ধ’ কোনোটারই প্রথাসিদ্ধ সংজ্ঞায় না পড়লেও ভিন্ন রকম একটি যুদ্ধে আপনারা জড়িয়ে পড়েছেন।
সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং বিরোধী জোট আন্দোলনের নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে। এখন আপনাদের বিরতিতে যেতেই হবে। এ বিরতিকে যে নামেই ডাকুন। ‘সংলাপ’, ‘সমঝোতা’, ‘আপস’ যা-ই বলুন অথবা সরাসরি ‘সাদা পতাকা উড়িয়ে যুদ্ধবিরতি’ বলুন, এক জায়গায় আসতেই হবে। কোনো বিরতিই কখনো নিঃশর্তে হতে পারে না। কিছু শর্ত অবশ্যই থাকবে। শর্ত থাকতে পারে সরকারের, শর্ত থাকতে পারে বিরোধী দল বা জোটের। তেমনিভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবে অন্য একটি পক্ষের শর্ত। এ পক্ষই এখন হবে সত্যিকারের প্রথম পক্ষ। এরা হবে দেশের সাধারণ নাগরিক, নির্দলীয় জনগণ। তাই ত্রিপক্ষীয় একটি সনদের খসড়া তৈরি করুন এবং তা জাতির সামনে তুলে ধরুন।
সরকারের দিক থেকে শর্ত হতে পারে নিম্নরূপ:
১. অবিলম্বে অবরোধ-হরতাল অন্তত এক বছরের জন্য বন্ধ হতে হবে।
২. দল–মতনির্বিশেষে সব বেআইনি ও সহিংস তৎপরতার বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির একটি বিশেষ ভূমিকা নতুনভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
বিরোধী জোটের শর্ত হতে পারে—
১. সব ধরপাকড়, পুলিশি সন্ত্রাস ও উসকানিমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে হবে।
২. দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনবিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃত নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে।
৩. সভা-সমিতির অবাধ অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৪. যুদ্ধাপরাধ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক নেতা ও দলের বিরুদ্ধে নতুন মামলা করা হবে না এবং সব পুরোনো মামলা আগামী এক বছরের জন্য স্থগিত থাকবে।
জনগণ ও নাগরিক সমাজের পক্ষের দাবি ও শর্ত—
১. এ আন্দোলন-সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদ এবং আহত ব্যক্তি ও নিহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনার জন্য চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত (আট মাস) ধরপাকড়, সন্ত্রাস, সহিংসতা বন্ধ থাকবে এবং উসকানিমূলক বক্তব্য কোনো পক্ষ থেকে আসতে পারবে না।
২. দেশে পেশাদার ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ‘সাংবিধানিক কমিশন’ গঠন করতে হবে। তাঁরা তিন মাসের মধ্যে ‘গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ, নির্বাচনসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের রূপরেখার একটি খসড়া তৈরি করবেন। তার পরের দুই মাস এ খসড়ার ওপর ব্যাপক আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময় হবে।
৩. মতবিনিময়ের ভিত্তিতে সব দল ও নাগরিক সংগঠনের ঐকমত্যে একটি ‘নাগরিক সনদ’ প্রণীত হবে।
৪. সব বন্ধ টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকা খুলে দিতে হবে। সব গণমাধ্যম উন্মুক্ত ও অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করবে।
৫. এই সনদে দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন স্বাক্ষর করবে।
৬. এই সনদের ভিত্তিতে একটি যৌক্তিক সময় নির্ধারণ করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
৭. নির্বাচনের পর যারাই সরকার গঠন করবে, তারা সনদের ভিত্তিতেই রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য সংস্কার কর্মসূচি পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করবে।
৮. এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের একটি প্রধান শর্ত হবে নির্বাচনে হার-জিত যা-ই হোক, কেউই সংসদ বয়কট করে লাগাতার অনুপস্থিত থাকতে পারবে না।
দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের মধ্য থেকে সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে ন্যূনতম কিছু শর্তের অধীনে শান্তি ও সমঝোতা স্মারক সই ও আলোচনা শুরু হতে পারে। এ-জাতীয় একটি উদ্যোগ নেওয়া হলে সরকার, বিরোধী দল ও দেশের সাধারণ মানুষ এর পেছনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: রাজনীতি বিশ্লেষক ও শাসন বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.