চাচার পাঁচালি, চা-চাল by মাহবুব তালুকদার

অনেকদিন  যাবৎ চাচা দেশে ছিলেন না। সুতরাং তার সঙ্গে কথকতার কোন সুযোগ ছিল না। তিনদিন পূর্বে চাচা দেশে ফিরে আমাকে ডাকলেন। সকালবেলা তার বাসায় গিয়ে দেখি তিনি পত্রিকা পাঠে ব্যস্ত। আমাকে দেখে সেদিনের দৈনিক পত্রিকা পাশে সরিয়ে রেখে বললেন, সুশীল সমাজের কাণ্ডটা দেখেছো?
না তো! আমি বললাম, কিসের কাণ্ড?
সেই চিহ্নিত লোকগুলো আবার মাঠে নেমেছে। ওরা এখন জাতীয় সংলাপ চায়! ওরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রীকে চিঠি দিয়েছে।
চাচা! চিঠি দিয়েছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা। ২০০৮ সালে তারই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে।
ওদের উদ্দেশ্যটা কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ধরে ফেলেছেন। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘এক-এগারোর কুশীলবরা সংলাপের এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে।’ ডক্টর শামসুল হুদা চিঠিতে স্বাক্ষর করলেও এর পেছনে আছে এক-এগারোর কুশীলবরা। চাচা জানালেন।
সত্যি বলতে কি, এক-এগারোর পটপরিবর্তন নিয়ে আমি খুবই বিভ্রান্ত। আজ পর্যন্ত আমার সেই বিভ্রান্তি কাটেনি। এই পটপরিবর্তন খারাপ ছিল, না ভালো ছিল আমি এখনও বুঝতে পারি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি গণতান্ত্রিক দেশে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে। তাতে দেশের গণতন্ত্র ধূলিসাৎ হয়, রাজনীতিবিদদের জেলে যেতে হয়, দেশের অর্থনীতি মার খায়। এক-এগারোতে সুশীল সমাজের কিছু লোককে সামনে রেখে সেনাবাহিনী প্রধানের নেতৃত্বে তখন দেশ চালানো হচ্ছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, ঐ পটপরিবর্তন ছিল তাদের ‘আন্দোলনের ফসল’। তিনি তখনকার কুশীলবদের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কুশীলবরা যেহেতু জনগণের আস্থা ও প্রশংসা অর্জন করেছে, সেহেতু ক্ষমতায় গেলে তিনি তাদের কার্যক্রমের বৈধতা দেবেন। কথাটা কি এখন সবাই ভুলে গেছেন? পরবর্তী সময়ে এক-এগারোর কুশীলবদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে মহীউদ্দীন খান আলমগীর জাতীয় সংসদে ও বাইরে অনেক হম্বিতম্বি করেছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি চুপসে যান। আমার মনে এখনও প্রশ্ন জাগে, এক-এগারোর কুশীলবদের শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচার করা হলো না কেন? সেটা কি, আওয়ামী লীগ ঐ পটপরিবর্তনের সুফলভোগী ছিল বলে?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে চাচা বললেন, কি ভাবছো? সুশীল সমাজের এবারের কা-কারখানা ভাবনার ব্যাপারই বটে। ওদের এবারের উদ্দেশ্য কিন্তু আরও মারাত্মক।
মারাত্মক মানে?
এবার ওরা একটা জাতীয় সনদ তৈরি করতে চায়। যাতে বিএনপি- জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের জেল থেকে ছেড়ে দেয়ার কথা থাকবে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বা ইতিমধ্যে যাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে, তাদেরকে ছাড়ার কথা নিশ্চয়ই থাকবে না। আমি জানালাম, আদালতের কার্যক্রম নিয়ে কারো বলার কিছু নেই। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্যের জন্য একটা সনদ তো হতেই পারে।
কিসের সনদ? চাচা উষ্মাভরে বললেন, আমাদের আইনমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, সংবিধানই হচ্ছে আমাদের সনদ। সংবিধানের পরে আর কোন সনদের প্রয়োজন নেই।
সংবিধান সম্পর্কেও আমার মনে একটা বিরাট বিভ্রান্তি আছে। সংবিধান জাতির সনদপত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যে মতবিরোধ, তা শুরু হয়েছিল সংবিধান নিয়ে বিতর্কের কারণে। সে অনুযায়ী অন্তত দু’টি টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছিল। তাতে নিশ্চয়ই বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করতো না। দেশও অস্থিতিশীলতার পথে যাত্রা করতো না। আমার মতে, সবাই সংবিধানের পাঠ নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেন। এখন মনে হচ্ছে, একটি সর্বদলের অংশগ্রহণের নির্বাচন ছাড়া জনগণের এই দুর্দশা কাটবে না, সেটা যখনই অনুষ্ঠিত হোক না কেন? সংবিধান অনুযায়ী সেটা নিশ্চয়ই সম্ভব। চাচাকে এসব কথা বলবো কিনা, বুঝতে পারলাম না।
কী? চুপ করে আছো কেন? চাচা বললেন, কিছু একটা বল।
আমি বললাম, দেশের যা অবস্থা! তাতে সংলাপ বা হানাহানি দুটোর যে কোন একটা পথ বেছে নিতে হবে।
ঠিক আছে। তোমার কথাই মানলাম, যে কোন একটা পথ বেছে নিতে হবে। বাট হোয়াই সংলাপ? অন্য অপশনটা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন?
হানাহানির পথে কি বর্তমান অবস্থার কোন সমাধান হতে পারে?
অবশ্যই পারে। তবে তোমার এই ‘হানাহানি’ শব্দটা আমার মোটেই পছন্দ নয়। হানাহানি তো করছে বিএনপি-জামায়াত জোট। কঠোর হস্তে হানাহানি দমনই কেবল এই অশুভ তা-ব থামাতে পারে।
কঠোর হস্তে দমন তো চলছেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস দমনের দায় নিজে নেয়ার পর কঠোর ব্যবস্থা নিতে আর কোন বাধা নেই। তারপরও এই হত্যাযজ্ঞ আর মানুষ পোড়ানো থামছে না কেন?
দুর্বৃত্তদের দমনের স্ট্যাটেজি ঠিক ছিল না। এবার ঠিক হয়ে যাবে। চাচা আশ্বাস দিয়ে বললেন, সুরঞ্জিত বাবু সন্ত্রাস দমনের পথ বাতলে দিয়েছেন।
কী সেই পথ? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
তিনি বলেছেন, একটি বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষিত বাহিনী তৈরি করে বর্তমান অবস্থার মোকাবিলা করতে হবে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও বিভিন্ন সময়ে কঠোর পদক্ষেপের কথা বলেছেন। তাদের উদ্দীপনামূলক ভাষণে দেশের মানুষও জেগে উঠেছে। সুতরাং সন্ত্রাস আর বেশিদিন টেকসই হবে বলে মনে হয় না।
চাচা! একটা কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
কী কথা? বলো!
পত্রিকায় দেখেছি, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণ বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ন করতে গিয়ে তার বিদেশ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, সে দেশের চলমান পরিস্থিতি তাদের হাতের বাইরে চলে যায়নি। শিগগিরই তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে’- এ কথার অর্থ কি?
তিনি ঠিকই বলেছেন। সত্যি বলতে কি, পরিস্থিতি এখনও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। শিগগিরই পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
চাচা! আপনার কথা আরও বেশি ঘোরালো হয়ে গেল। পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না গিয়ে থাকে, তাহলে শিগগিরই তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে কী করে? আমি এর অর্থ বুঝতে পারছি না।
অর্থ খুবই সোজা। পঙ্কজ শরণ ডিপ্লোম্যাট বলে ডিপ্লোম্যাটিক ভাষায় কথাটি বলেছেন। আসলে তিনি বলতে চেয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। আরও অধিকতর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে। যাকগে। আমাদের দেশের অবস্থা নিয়ে আমরা বিদেশীদের কথায় মোটেই পাত্তা দিচ্ছি না।
সহসা চাচা উঠে গিয়ে টেলিভিশন চালু করে দিলেন। রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপতে টিপতে বললেন, আমি তো একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম।
কি ভুলে গিয়েছিলেন?
আজ ভারতে দিল্লির বিধান সভার ফলাফল ঘোষণার কথা। সেখানে কে ক্ষমতায় আসে, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির প্রার্থী সাবেক ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার কিরণ বেদী আর অন্যদিকে আম আদমি পার্টির বা এএপি’র প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। দুজনের মধ্যে রীতিমত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। নির্বাচনে হেরে গেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য তা হবে এক মারাত্মক আঘাত। কারণ, এই নির্বাচনে তার পার্টিকে জেতাবার জন্য তিনি কী না করেছেন!
চাচা টিভির চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে এনডিটিভি ধরলেন। ততক্ষণে নির্বাচন ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। নির্বাচনে আম আদমি পার্টি ও কেজরিওয়াল বিজেপি প্রার্থীদের বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাভূত করেছেন, ভূমিধস বিজয় বললেও তা কম বলা হয়। ৭০টি আসনের মধ্যে এএপি ৬৭ আসনে জয়ী হয়েছে, বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৩টি আসন। কংগ্রেস কোন আসন পায়নি। কিন্তু কি আশ্চর্য! এই নির্বাচন নিয়ে সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির কোন প্রশ্ন ওঠেনি। টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেজরিওয়ালকে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আম আদমির রাজ্য সরকারকে ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
আমি বললাম, ভারতের এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কাছ থেকে আমাদের রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নেয়া উচিত।
চাচা আমার কথার জবাব না দিয়ে টেলিভিশনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললেন, দেখ! কেজরিওয়াল তার প্রতিদ্বন্দ্বী কিরণ বেদীকে কোন প্রকার কটূক্তি বা তার সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে কিরণ বেদীও কেজরিওয়ালকে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এমন সম্প্রীতি কি আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সম্ভব?
চাচা এবারও আমার কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, নরেন্দ্র মোদি আম আদমি প্রধান কেজরিওয়ালকে এবার একটা দারুণ চাল দিয়েছেন।
কী সেই চাল? আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম।
নরেন্দ্র মোদি কেজরিওয়ালকে চা খেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
এটা তো ভালো কথা। এতে চাল বা চালবাজির কি হলো?
তুমি তো রাজনীতির কিছুই বোঝ না। তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চালটা ধরতে পারছো না, বুঝতেও পারছো না।
আপনি বুঝিয়ে দিলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবো।
শোনো। ক’দিন আগে নরেন্দ্র মোদি নিজের হাতে চা বানিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে খাইয়েছেন। সেই চা খেয়ে ওবামা মোদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভারত-আমেরিকার দ্বিপক্ষীয় জটিল বিষয়গুলোর সমাধান হয়ে গেল চায়ে চুমুক দিতে দিতে। মোদি জানেন, চা খাইয়ে প্রতিপক্ষকে কিভাবে কব্জা করতে হয়।
চাচা! কেজরিওয়ালকে চা খাইয়ে কী মোদি তাকেও হাতের মুঠোয় আনতে পারবেন?
আমার কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে চাচা বললেন, বারাক ওবামাকে চা খাইয়ে যিনি কাবু করেছেন, তার কাছে কেজরিওয়াল কোন ছার! একটু হেসে তিনি আবার বললেন, নরেন্দ্র মোদির মতো চা আর কেউ বানাতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.