রঙের আঁচড়ে পথপ্রান্তরে বর্ণালি উচ্ছ্বাস by মানসুরা হোসাইন

ই সহযোগীর সঙ্গে শিল্পী রুহুল আমিন কাজল (মাঝখানে)
ছবি আঁকছেন শিল্পী রুহুল আমিন কাজল
শিল্পী রুহুল আমিন কাজলের করা ট্রাফিক আর্টের ছবি
ফিতার মতো চলে যাওয়া কোনো একফালি রাস্তা কিংবা কোনো উদোম চত্বর পেলে আর কি চাই তাঁর? মনের সুখে সেখানে আঁকতে বসে যান। এটাই তাঁর ছবি আঁকার ক্যানভাস। খেলার মাঠ বা কোনো বিদ্যালয়ের সামনের প্রাঙ্গণেও ছবি আঁকেন তিনি। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ নানা রঙের বাহারে বর্ণিল হয়ে ওঠে বিভিন্ন ছবি। আকাশ, নদী, মানুষ, ফুল, পাখি—কত কিছুই না আঁকেন তিনি। তাঁর তুলির আঁচড়ে নিষ্প্রাণ পথ আর চত্বরে ফোটে জীবনের গান।  এই মানুষটি হলেন রুহুল আমিন কাজল। বাংলাদেশ ছাড়াও এ পর্যন্ত ভারত, আরব আমিরাত, ইতালি, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, মেক্সিকো, চেক প্রজাতন্ত্রসহ মোট ১৩টি দেশে ছবি এঁকেছেন। তিনি বলেন, এ শিল্পের নাম হচ্ছে ‘ট্রাফিক আর্ট’। বাংলা করেছেন—‘চলার পথে কলার কথা’।
সুইডেনে ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি কাজও করেছেন সড়কচিত্রের শিল্পী রুহুল আমিন। এ কাজের পাশাপাশি পাথর খোদাই করা ভাস্কর্য, কাঠের ভাস্কর্য তৈরি, ম্যুরাল তৈরি এবং ছবি আঁকার কাজও চলছে। ট্রাফিক আর্টে এ শিল্পীকে প্রায় বেশির ভাগ সময় সহযোগিতা দেন প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশি উত্তম কর্মকার ও কলম্বিয়ার রুবেন মার্তিনেজ।
১৯৮৬ সাল থেকে সুইডেনপ্রবাসী রুহুল আমিন এখন বাংলাদেশে। কাল শনিবার রাজধানীর শাহবাগে চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তায় ছবি আঁকবেন। প্রথমে রাস্তায় সাদা রং করা হবে। সেখানে উড়বে নারীর শাড়ির আঁচল। শাড়ির পাড়ও থাকবে। তারপর কালোসহ বিভিন্ন রং দিয়ে আঁকা হবে নানা বিষয়। এখানে নারীর অবয়বকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। সেদিন শাহবাগে সবাই আসবেন বিশ্বব্যাপী আন্দোলন ‘উদ্যমে উত্তরণে শতকোটি’ প্রচারণায় অংশ নিতে। ‘উদ্যমে উত্তরণে শতকোটি’ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ আয়োজন। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই বিকেল তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত চলবে নানান আয়োজন।
এ আন্দোলনে পুরুষের সম্পৃক্তকরণের অংশ হিসেবেই রুহুল আমিন ও তাঁর সঙ্গের সহযোদ্ধারা রাস্তায় ছবি আঁকবেন। ১৯৮৬ সালে ডেনমার্কে পাড়ি জমানোর আগে রুহুল আমিন বাংলাদেশে পুরুষ শাসিত সমাজের প্রতিচ্ছবি নিয়ে ‘সোসাইটি’ নামে একটি ছবির প্রদর্শনী করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা হয় রুহুল আমিনের সঙ্গে। তিনি এ কে এ রা কাজল নামেও পরিচিত। তাঁর দাদার বাড়ি গফরগাঁও। ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় নানিবাড়িতে জন্ম তাঁর। সত্তরের দশকে ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে সিরামিকে পড়াশোনা করেন তিনি। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ব্যাচেলর অব ফাইন আর্টস থেকে ড্রয়িং এবং পেইন্টিং বিষয়ে পড়াশোনা। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে চার মাসের গ্রাফিক প্রিন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ডেনমার্কের নাগরিক লিস রাসমুসেনকে বিয়ে করেন রুহুল আমিন। তারপর পাড়ি জমান ডেনমার্কে।
রুহুল আমিন বলেন, ‘এখন অনেকেই পাবলিক আর্টের সড়কচিত্রের মাধ্যমটি ব্যবহার করছেন। তবে বাংলাদেশি হিসেবে আমি যখন কাজটি শুরু করি, তখন সম্ভবত আর কেউ তা করেননি। এখন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে সহজেই এ কাজের জন্য অনুমতি মেলে। বিভিন্ন সংগঠন কমিশনের বিনিময়ে কাজের অর্ডার দিচ্ছে। চারটা বড় কাজ করতে পারলে সারা বছরে আয় রোজগারের জন্য আর সেভাবে চিন্তা না করলেও চলে।’
কোনো জায়গার চিত্রকলা নষ্ট হয়ে গেলে, শিশুদের খেলার জায়গাকে আকর্ষণীয় করার জন্য, বড় কোনো উৎসব সামনে রেখে বা বিভিন্ন কারণেই ট্রাফিক আর্টের জন্য অনুরোধ পান রুহুল আমিন। তিনি বলেন, এ শিল্পকে রংধনু শিল্প বলা হয়। একদিকে যেমন প্রচুর রং ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে এ আর্টের স্থায়িত্ব কত দিন হবে, তা কেউ বলতে পারে না। দামি রং ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করতে হয়। ফলে খরচাপাতিও অনেক। যেসব সংগঠন অর্ডার দেয়, সেসব প্রতিষ্ঠানকে বাজেট জানিয়ে দেন রুহুল আমিন। রুহুল আমিন নিজের চিন্তাভাবনা থেকে স্বাধীনভাবে একটি থিমের বর্ডার আঁকেন। তারপর সেখানে শিশুসহ নানান বয়সী মানুষ রং দিয়ে সাজাতে থাকেন। তবে পুরো কাজটির নিয়ন্ত্রণ করতে হয় রুহুল আমিনকেই। তিনি বলেন, এ কাজে শিশুদের মধ্যে উৎসাহ বেশি। তারা নির্দিষ্ট জায়গায় আঁকতে পছন্দ করে না। ফলে তদারকি বেশি করতে হয়। তবে এ কাজটাকে তারা খুব উপভোগ করে। ফলে বেশ কয়েক বছর পরে দেখা হলেও তারা সেই অভিজ্ঞতার কথা জানায়। তত দিনে তারা অনেক বড় হয়ে গেছে।
ট্রাফিক আর্টের সুবিধা বর্ণনা করে রুহুল আমিন বলেন, ছবি আঁকার ক্যানভাসটা বিশাল। বদ্ধ জায়গায় কাজ করতে হয় না। বড় লাঠির মাথায় ব্রাশ লাগিয়ে স্বাধীনভাবে আঁকা যায়। চারপাশের অভিজ্ঞতায় গাছ, লতাপাতা, ফুল, পাখি, ময়ূর—কীই না থাকে সেখানে। এ ধরনের দৃশ্য দেখে মন প্রফুল্ল হয়। এক নারী বলেছেন, অফিসে বসে তিনি যখন নিচের দিকে তাকিয়ে রাস্তার দৃশ্য দেখেন, তখন তাঁর মন ভালো হয়ে যায়। এ চিত্রের মূল উদ্দেশ্যই সেখানে। ফলে এ ধরনের চিত্র শিল্প জগতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
রুহুল আমিন জানান, ২০০৮ সালে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে জার্মানির বনে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রাঙ্গণে ট্রাফিক আর্টে প্রাধান্য পায় জলবায়ু পরিবর্তন, মানুষ, পানি ইত্যাদি। অনেক জায়গায় এ শিল্পী ‘ড্যান্সিং পারফরম্যান্স’-এরও আয়োজন করেন। এটি হচ্ছে সড়কে একটি চিত্র থাকে। মানুষের শরীরেও তা আঁকা থাকে। মানুষগুলো নড়াচড়া করলে ছবিকে জীবন্ত মনে হয়।
রুহুল আমিনের স্ত্রী ১৯৭২ সাল থেকে নানাভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ দেশে এসেছিলেন যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে। তারপর ডেনমার্কের সহায়তায় বাংলাদেশি এনজিও পরিচালনাসহ নানাভাবে বাংলাদেশে নিয়মিত যাতায়াত। ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও অফিসের সভার ফাঁকে বা অন্য সময় যে আঁকিবুকি করেন, তা যথেষ্ট ভালো হয় বলেই মনে করেন রুহুল আমিন। ফলে স্ত্রীকে এসব নষ্ট না করে সংরক্ষণ করতে বলেছেন। এ ছাড়া যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কাজের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বই বের করারও ইচ্ছা আছে। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই। রুহুল আমিনের বাবা আফাজ উদ্দিন ছিলেন টেলিগ্রাফ অফিসের প্রধান সুপারিনটেনডেন্ট। মা ছামিরুন নেছা। তাঁরা মারা গেছেন। তাঁরা ১৩ জন ভাইবোন।
নতুন কিছু করার চিন্তা সব সময়ই মাথায় ঘুরপাক খায় রুহুল আমিনের। গতানুগতিকতার বাইরের কাজ করাই তাঁর নেশা। তাই ৪০ ফুট কনটেইনারে করে বিমান ভাড়া দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বাঁশ নিয়ে যান ডেনমার্কে। সেখানে সেই বাঁশ দিয়ে নানান কাজ করেন। গত বছরের মার্চে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে ‘কনসপির‌্যাচুয়াল’ শিরোনামে ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এ প্রদর্শনীর মূল প্রতিপাদ্য ছিল বর্তমানের অত্যাধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার। এতে দেখানো হয়েছে, মানুষের সবার মাথা একই রকম, তা দেখতে রোবটের মতো।

No comments

Powered by Blogger.