মাতৃভাষায় শিক্ষার স্বপ্ন এখনও অধরা by রাজীব নূর

জন্মের পর থেকে বিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা রাখা পর্যন্ত যে ভাষার সঙ্গে একেবারেই পরিচয় ছিল না, সে বাংলা ভাষাতেই পড়াশোনা শুরু করতে হয়েছিল প্রতিভা ত্রিপুরাকে। সেটা আশির দশকের একেবারে শেষ দিককার কথা। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার পোমাংপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ছিল ত্রিপুরা জাতির, যাদের মাতৃভাষা ককবরক। কষ্ট করে বাংলা বর্ণমালা শিখলেও বাংলা শব্দ তো তার পুরোই অজানা ছিল। ফলে ছোটবেলায় লেখাপড়াটা তার কাছে সবচেয়ে কঠিন কাজ বলে মনে হতো। প্রতিভা এখন নিজেই একজন শিক্ষক। শিক্ষকতা করেন দীঘিনালার মহালছড়ি হেডম্যানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার চাওয়া_ বাংলাদেশের আদিবাসী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শুরু করবে নিজেদের মাতৃভাষায়। অথচ তিনি নিজে যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন, সেখানে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু হলেও নেই আদিবাসীদের নিজের ভাষা শিক্ষাদানের মতো শিক্ষক। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা পাওয়ার যৌক্তিকতা বোঝাতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন তন্দ্রা চাকমা। আদিবাসী বিষয়ক এই গবেষক ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর শিক্ষকতা করেছেন। তার ছাত্রছাত্রীদের সবাই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার বিভিন্ন জনজাতির শিশুরা। তন্দ্রা চাকমা বলেন, 'আমার এক ম্রো ছাত্রের কথা মনে আছে। এই ছাত্রটি ক্লাসে কিছুতেই পড়া পারত না। বুঝতে পেরেছে কি-না জিজ্ঞেস করা হলে ছাত্রটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিত। পরে কে যেন বলল, তাকে তার ভাষা জানে এমন কারও মাধ্যমে সমস্যাটা জিজ্ঞেস করা হোক। আমি নিজে চাকমা হওয়ার কারণে তার ভাষা আমার জানা ছিল না। পরে রাঙামাটির মোনঘর শিশুসদনের এক ম্রো ছাত্রের সহযোগিতায় আমার ওই ছাত্রটির সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারি, এতদিন আমি ও তার অন্য শিক্ষকরা যা বলেছি, সেসবের বিন্দু-বিসর্গও সে বুঝতে পারেনি। মোনঘরের ছাত্রটির সহায়তা নিয়ে অনুবাদ সহকারে তাকে পড়াতে শুরু করার কিছু দিনের মধ্যে সে ক্লাসের আর সবার চেয়ে বেশ মনোযোগী হয়ে উঠল। তিন মাসের মাথায় সে চাকমা ও বাংলা ভাষায়ও পারদর্শী হয়ে উঠল। তখন আমি ও অন্য শিক্ষকরা বুঝতে পারলাম, প্রথম শ্রেণীতে যারা পড়তে আসে, তাদের আগে পাঠ্যবইয়ের বিষয়গুলো যদি মাতৃভাষায় আলোচনা করে বোঝানো যায়, তাহলে পরে তারা বাংলা ও ইংরেজি ভাষা খুব ভালোভাবে শিখবে।'
পার্বত্যাঞ্চলে কর্মরত একটি উন্নয়ন সংস্থা সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিআইপিডি) নির্বাহী পরিচালক জনলাল চাকমা বলেন, নিউজিল্যান্ডে এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মাওরি শিশু মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে তারা শুধু ইংরেজিতে শিক্ষা গ্রহণকারী শিশুদের চেয়ে ভালো ফল করছে। এমন আরও অনেক গবেষণা থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে, মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ফলের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। তাই আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় আদিবাসীদের ভাষা প্রয়োগ ও প্রচলনের দাবি জানিয়ে আসছি। এর ফলে ২০১০ সালে চালু হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে আদিবাসীদের মাতৃভাষা শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে।পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগে আদিবাসীদের মাতৃভাষার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির খ খ ের ৩৩ নম্বর ক্রমিকের খ (২) নম্বর উপ-অনুচ্ছেদে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা উল্লেখ থাকায় বাংলা ভিন্ন অন্যান্য ভাষাভাষীর মাতৃৃভাষা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের মাতৃভাষার ভূমিকা কী হবে, এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতিতে অস্পষ্টতা রয়েছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী প্রশান্ত ত্রিপুরা। তিনি বলেন, সংবিধানে আদিবাসী শব্দটির ঠাঁই না মিললেও ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতে এটি ছিল। তাই তখন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ শিক্ষানীতিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে যে 'মাতৃভাষায় শিক্ষা'র বদলে 'মাতৃভাষা শিক্ষা'র কথা বলা হয়েছে, তা অনেকে হয়তো খেয়াল করেননি। তিনি বলেন, ছাপার ভুলে 'য়' বাদ গিয়ে 'মাতৃভাষা শিক্ষা' হয়নি, বরং কথাটা সচেতনভাবেই এভাবে লেখা হয়েছে_ এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, আদিবাসীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা ও মাতৃভাষায় শব্দটি নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে। ইংরেজিতে বলা হয়েছে_ থ্রু মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ। অর্থাৎ, মাতৃভাষায়। কিন্তু বাংলায় 'য়' বাদ পড়েছে। 'মাতৃভাষা শিক্ষা' বলতে মন্ত্রণালয় মাতৃভাষায় শিক্ষাই বুঝিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু আদিবাসীরা ২০১০ সালে চালু হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন মাতৃভাষায় শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেখে স্বাগত জানিয়েছিল। সে অনুসারে একটি জাতীয় কমিটিও গঠিত হয়েছিল ২০১২ সালে। কমিটির প্রধান কাজ ছিল আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উপকমিটি গঠন।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক সৌরভ সিকদার নিজেও ওই কমিটির একজন সদস্য। কমিটিতে আদিবাসী নেতারাসহ ভাষাবিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষাবিষয়ক কর্মকাণ্ডে অভিজ্ঞ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কয়েকজন প্রতিনিধিও ছিলেন। এ কমিটির পরিকল্পনায় প্রাথমিকভাবে ছয়টি আদিবাসী ভাষাকে চিহ্নিত করা হয়, যাদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হবে এবং ভাষাভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছয়টি ভাষা হচ্ছে_ চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, সাদরি, ত্রিপুরা ও মান্দি। পরবর্তীকালে লিপি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান না হওয়ায় সাঁওতাল ভাষাকে সাময়িকভাবে বাদ রাখা হয়। এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক তৈরি ও পাঠদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সেভ দ্য চিলড্রেনের আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিয়োজিত শিশুর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের পরিচালক মেহেরুন্নাহার স্বপ্না বলেন, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে গঠিত এমএলই (মাল্টি লিঙ্গুয়াল এডুকেশন) ফোরামের অ্যাডভোকেসির ফল হিসেবে সরকার ২০১০ সালের শিক্ষানীতির মধ্যে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার স্বীকৃতি দিয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। এই কাজে বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে আদিবাসী সমাজকে সম্পৃক্ত করা হবে। পরে ২০১৩ সালে মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, সাদরি ও গারো শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৪ সালে কার্যক্রম শুরু করার কথা ছিল। ২০১৪ পেরিয়ে ২০১৫ সাল চলছে। এখনও সরকারিভাবে তা আরম্ভ করা হয়নি।
সরকারিভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষা চালু করা না গেলেও ২০০৬ সাল থেকে সেভ দ্য চিলড্রেন পার্বত্য চট্টগ্রামে জাবারাং কল্যাণ সমিতিসহ স্থানীয় কিছু উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন মেহেরুন্নাহার স্বপ্না। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন ও ম্রো ভাষার ২৬ হাজার ২৮৫ শিশু কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে এবং আট হাজার ৯৫৭ শিশু প্রাক-প্রাথমিক শেষে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা জানান, খাগড়াছড়ির ৫০টি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা। তবে তিনি মনে করেন, এটি ব্যাপকভাবে সফল করার জন্য সরকারি উদ্যোগের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় বই প্রণয়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে কেবল বই প্রকাশ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না বলে মনে করেন তিনি। এ জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।আগামীকাল পড়ূন :চাকমাদের দুঃখিনী বর্ণমালা

No comments

Powered by Blogger.