কূটনীতি- ওবামার ভারত সফর ও ‘ব্যক্তিগত’ বিড়ম্বনা by ফারুক মঈনউদ্দীন

সাত্ত্বিক ঠাকুরের পঞ্জিকা পড়ার মতো আমার জোড়া পাসপোর্টের পাতার পর পাতা উল্টে যাওয়ার পর দিল্লি এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারের প্রশ্নটা শুনে আমি তাজ্জব বনে যাই, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপ পাকিস্তানসে আ রাহা হুঁ?’ আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলেও ইমিগ্রেশন অফিসারদের সঙ্গে বেশি তর্ক করা ঠিক নয় ভেবে আমি কণ্ঠে যথাসাধ্য বিনয় যুক্ত করে বলি, আরে, কী বলছেন আপনি? দুনিয়ার এত দেশ ঘুরলেও অই দেশটিতে কখনোই যাইনি আমি। সরাসরি ঢাকা থেকে এলাম আপনাদের জেট এয়ারওয়েজে। কেন আমার পাসপোর্টে পাকিস্তানের ভিসা বা মোহর দেখা যাচ্ছে? লোকটি এই কথার কোনো জবাব না দিয়ে বেশ সময় নিয়ে আমার পাসপোর্টে মোহর মারে। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টটা বিশাল, সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতোই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ বলে এবং ঢাকার সঙ্গে তুলনা করি বলেই ‘বিশাল’ বিশেষণটা আপনা-আপনিই চলে আসে। চলন্ত হাঁটাপথ না থাকলে অত দূর পথ হেঁটে এসে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পৌঁছাতে জিব বেরিয়ে যেত। ইমিগ্রেশন কাউন্টারগুলোর সামনে বহু আফগানি যাত্রীকে দেখে ভাবছিলাম, আমাদের কপালের বিড়ম্বনা আজ ঠেকায় কে। এমনিতেই ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে একেবারে শেষ সময়ে প্রায় দৌড়ে প্লেনে উঠতে হয়েছিল বলে তখনই মনে কুডাক দিচ্ছিল। ঢাকার ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আরও চটপটে কম্পিউটার ÿঅফিসারদের বসালে এই যাত্রী ভোগান্তির কিছু অবসান ঘটতে পারে, এই কথাটা প্রতিবার বিদেশ যাত্রার সময় ইমিগ্রেশন করতে এসে মনে পড়লে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সার্ভিসের বন্ধুদের বলতে চেয়েও বলা হয়নি। আমাদের সবুজ পাসপোর্ট দেখেও সেবার ভোরবেলায় রোম বিমানবন্দরে একটিও প্রশ্ন না করে ঘুম ঘুম চোখে অফিসারটি যখন আমাদের পাসপোর্টগুলো স্ক্যান করার পর ঝপাং করে মোহর মেরে দেন, সেদিনই উপলব্ধি করেছিলাম, আমাদের এখানে আরও কিছু ডিজিটাল সংস্কার প্রয়োজন।
দিল্লিতে আমার স্ত্রীর পাসপোর্টটা স্ক্যান করার পর অফিসারটি আচমকা উঠে গিয়ে ওটা ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য সহকর্মীর হাতে তুলে দেন এবং লোকটি পাসপোর্টের পাতার পর পাতা উল্টে যেতে থাকেন, তখন মনে হলো, তাঁরা নারী তালেবান বা আইএস জঙ্গিদের কারও সন্ধান লাভ করেছেন। ততক্ষণে পাশের কাউন্টার থেকে আমার ডাক পড়ে। আমাকে অন্য কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াতে দেখে পাসপোর্টের মালকিন এপাশ থেকে অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলেন, ‘ক্যায়া কুছ গড়বড় হ্যায়?’ তখন লোকটি পাসপোর্টসমেত ফিরে এসে বলেন, ‘মেরা মেশিন খরাব হ্যায়।’ তারপর অন্য কাউন্টার দেখিয়ে ওখানে যেতে বলেন। এর মধ্যে আমার পাসপোর্টে কিংবা জাতীয়তায় পাকিস্তানি যোগাযোগ আবিষ্কার করে ফেলার কথা প্রথমেই বলেছি। দিল্লি এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারের পাকিস্তান থেকে আসছি কি না, প্রশ্নটা যতই সাদামাটা মনে হোক না কেন, আপাতনির্দোষ প্রশ্নটির ভেতর লুকিয়ে আছে বহু গুরুতর বিষয়। কারণ, পাসপোর্টে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি সূত্রও না পাওয়া সত্ত্বেও কেবল সবুজ পাসপোর্টধারী হওয়ার কারণে এ রকম প্রশ্ন আমাদের স্বাধীন জাতীয় সত্তা ও ভাবমূর্তির জন্য অবমাননাকর। এ রকম প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত ১০ ট্রাক অস্ত্র কিংবা মুম্বাইয়ের ট্রেনে বিস্ফোরণের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কোনো মহলের জড়িত থাকার ভারতীয় অভিযোগ। মুম্বাইয়ের ট্রেন বিস্ফোরণের অব্যবহিত পর কলকাতা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনেও এই লেখককে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছিল।
এবার দিল্লি পৌঁছার ঠিক দুই দিন পর ভারতের ৬৬তম প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ভারত সফরে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কেবল আসা নয়, ওবামাই হচ্ছেন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি প্রজাতন্ত্র দিবসের আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের প্রধান অতিথি। অতএব দিল্লিজুড়ে সাজ সাজ রব হওয়াই স্বাভাবিক।
বিমানবন্দর থেকে মধ্য দিল্লিতে আসার পথে পড়ে আইটিসি মৌর্য হোটেল, এখানেই ওবামা ছিলেন। তাঁর নিরাপত্তার কারণে হোটেলটির রেস্তোরাঁতেও সব ধরনের সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন রাস্তার পাশ দিয়ে আনুষ্ঠানিক পোশাক পরা সওয়ারিসহ উটের একটা দীর্ঘ শোভাযাত্রা যাচ্ছিল, দুই দিন পরই প্রজাতন্ত্র দিবস, অতএব এসব মহড়া খুব স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু ধাক্কাটা লাগে আমাদের হোটেলে ঢোকার সময়। ঢাকার বড় হোটেলগুলোয় গাড়ি নিয়ে ঢোকার সময় গাড়ি চেক করা প্রায় গা-সহা হয়ে গেছে। কিন্তু দিল্লির চারতারা হোটেলটিতে বোর্ডার বা অতিথিদেরও শরীরে হাত দিয়ে আগাপাছতলা সার্চ করা দেখে বোঝা যায়, দিল্লি পুলিশের নির্দেশ অমান্য করার হিম্মত কিংবা ইচ্ছা এদের নেই। হোটেল থেকে বাইরে গেলে ফেরার সময় প্রতিবারই ব্যাগ তল্লাশি, শরীর তল্লাশিকে বাড়াবাড়ি রকম সতর্কতা মনে হলেও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা মারাত্মক জঙ্গি হামলার কারণে পুলিশের এই বাড়তি সতর্কতাকে মেনে না নিয়ে উপায় থাকে না। তবু হোটেলের অপ্রশিক্ষিত নিরাপত্তারক্ষীদের একজন নতুন দায়িত্ব পেয়ে ক্যামেরার ব্যাগ খুলে লম্বা লেন্সটা আবিষ্কার করে সেটিকে দুরবিন মনে করে চোখে লাগিয়ে দেখতে চাইলে কণ্ঠে রাগ গোপন রেখে বলতে হয়, ভাইসাব, ইয়ে ক্যামেরা কা লেন্স হ্যায়। কনট প্লেসের একটা ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের দোকানে ঢুকতে চাইলে প্রহরী জানান, ক্যামেরা নিয়ে ঢোকা যাবে না। পরে বহু ঝামেলার পরও যখন ব্যাগের ভেতর ক্যামেরাটির প্রকৃত কাজ নিয়ে সন্দেহ করে জিনিসটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এটা-সেটা টেপাটেপি করে দেখতে গিয়ে ওটা প্রায় বিকল করে ফেলার উপক্রম করে, তখন তাকে বুঝিয়ে বলতে হয়, এটি আসলেই ক্যামেরা, কোনো দূরনিয়ন্ত্রিত অস্ত্রের কন্ট্রোল নয়। বৃদ্ধ লোকটিকে নাজেহাল করার জন্য তাঁর একটা ছবি তুলে দেখিয়ে দিতে চাইলে তিনি নিরস্ত হন। প্রজাতন্ত্র দিবস সামনে রেখে যেদিকেই যেতে চাই, ট্যাক্সিওয়ালাদের এককথা, ‘উধার বন্ধ হ্যায়।’ অথবা অনেক রাস্তা ঘুরে যেতে হবে, ‘বারাক ওবামা আ রাহা হ্যায় না?’ একজন তো রগড় করে বলেই ফেললেন, ‘ইয়ে ব্রেক ওবামা হ্যায়, সব কুছ ব্রেক কর দিয়া।’
ওবামার ভারত সফর বর্তমান ভারত সরকারের জন্য অবশ্যই বড় ঘটনা। এর আগে ১৯৯৪ সালে নরসিমা রাও যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তখন প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যদিও ক্লিনটন সে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। সে ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি সরকারের হিন্দুত্ববাদী ভাবমূর্তি সত্ত্বেও এই সরকারের সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সেটিকে কার্যকর করেছেন, তা ভারতের বর্তমান সরকারের জন্য একটা বিশাল বিজয় হিসেবে ধরে নিচ্ছেন দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে ২০০২ সালে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার খানেক মুসলমান নিহত হওয়ার পর সেই দাঙ্গার উসকানিদাতা মনে করে ২০০৫ সালে তখনকার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়া হয়নি। সেই মোদির আমন্ত্রণ পেয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা নাকি বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু স্বয়ং ওবামা এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করায় কারও আর বিস্ময়ের অবকাশ থাকে না। মোদি তাঁর এই আমন্ত্রণের সাফল্য দিয়ে এক ঢিলে অন্তত দুটি পাখি মেরেছেন। প্রথমত তিনি ভারতের আজন্ম শত্রু পাকিস্তানকে দেখিয়ে দিতে পেরেছেন যে উপমহাদেশীয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র যত মহাশক্তিই হোক না কেন, সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং ভারতের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকছেন। দ্বিতীয় পাখিটি তিনি মেরেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র যে একজন ভারতীয় মুখ্যমন্ত্রীকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে ভিসা দেয়নি, সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং তাঁরই অতিথি। আরও কত পাখি যে উভয় তরফে বধ হয়েছে, সেটি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিষয়। যেমন ওবামা ইন্ডিয়া গেট-সংলগ্ন প্যারেড গ্রাউন্ডের উন্মুক্ত জায়গায় তিন ঘণ্টা বসে থেকে ভারতের সামরিক সরঞ্জামের যেসব প্রমাণ দেখেছেন, তার মধ্যে রাশিয়ান সমরাস্ত্রও আছে, সেটিরও রয়েছে কূটনৈতিক অর্থনীতি। অতএব মোদি যে এক ঢিলে একাধিক পাখি মেরেছেন তা যেমন ঠিক, ওবামাও বহু পাখি যে মেরেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। তবে নরেন্দ্র মোদি তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের অভিষেক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাতে কতটুকু আন্তরিকতা ছিল বোঝা যায়, কারণ এই আমন্ত্রণ সত্ত্বেও ভারতীয় পক্ষ থেকে পাকিস্তানের প্রতি কঠোর মনোভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তা না ঘটাই উচিত পাকিস্তানের মতো একটি দেশের জন্য। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের এই নতুন মেরুকরণ উপমহাদেশের রাজনীতিতে কতখানি প্রভাব ফেলবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে মোদি সরকারের জন্য এটা একটা বড় বিজয়, এ কথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নন এমন মানুষও সহজেই বুঝতে পারবেন। আন্তর্জাতিক বা উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব উপেক্ষা করার মতো নয়, এবং সেই সম্পর্কের প্রভাব থেকে আমাদের জন্য হিতকর কিছু আহরিত হোক, এটা কামনা করা ছাড়া আমজনতার আর বেশি কিছু চাওয়ার নেই।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.