পুরান সুতায় নতুন দিন by এ এস এম আলমগীর

(ঝুট কাপড় থেকে সুতা ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ত বিরামপুরের গ্রামের এক নারী l ছবি: প্রথম আলো) দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার শিবপুর (আলীপুর), আমাইল, কসবা চাপড়া, অচিন্তপুরসহ বেশ কিছু গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এখন শোনা যায় ছোট্ট ছোট্ট চরকায় সুতা ছাড়ানোর শব্দ। গ্রামগুলোর নারীরা ঘরের কাজ সেরে বসে পড়েন চরকা নিয়ে। এতে বেশ বাড়তি আয় হচ্ছে তাঁদের। সংসারে আসছে সচ্ছলতা। এই সুতা ছাড়ানোর কাজই হয়ে উঠেছে অনেক অভাবী মানুষের জীবিকার অবলম্বন। গ্রামগুলোতে এই সুতা ছাড়ানোর কাজ এসেছে চাপড়া গ্রামের মো. জুয়েল (৩০) নামের এক যুবকের হাত ধরে। শুরুটা প্রায় সাত বছর আগে। নিজের আঙিনায় চরকা বসিয়ে সুতা ছাড়ানোর মাধ্যমে যার সূচনা করেছিলেন তিনি।
গোড়ার কথা: ১৯৯৪ সালে মারা যান জুয়েলের বাবা নাজিম উদ্দিন। দুই ভাই-দুই বোনের মধ্যে তৃতীয় জুয়েল। বাবার তেমন জমিজমা ছিল না। অন্যের জমিতে কাজ করতেন। সারা দিন খেটে যে মজুরি পেতেন, তাতে কোনোমতে দুই বেলা খাবার জুটত। তাই ছোটবেলাতেই অভাবকে হাড়ে হাড়ে চিনেছিলেন তিনি। ২০০৭ সালের কথা। একদিন জুয়েল বেড়াতে যান নওগাঁ জেলার সান্তাহারের শাওল বাজারে। সেখানে থাকতেন ভাগনিজামাই মো. রায়হান (৩০)। গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় ও পুরোনো কাপড় থেকে সুতা তুলে রশি তৈরি করতেন রায়হান। সান্তাহার ছাড়াও ঢাকা, কুষ্টিয়া, বগুড়া থেকে ক্রেতারা এসে তাঁর (রায়হান) কাছ থেকে রশিগুলো কিনে নিয়ে যান। জুয়েল দেখলেন, পাট বা নাইলনের রশির মতো এই রশিও ঘর-গৃহস্থালির সব কাজে ব্যবহার করা যায়। সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজের বাড়িতেও এই কাজ করবেন তিনি। তাই ঝুট বা পুরোনো কাপড় থেকে সুতা ছাড়ানো এবং সেই সুতা দিয়ে রংবেরঙের রশি তৈরির কাজ শেখা শুরু করলেন। দেখলেন, সোয়েটার থেকে উলের সুতা যেভাবে খোলা যায়, ঠিক তেমনি পুরোনো বা ঝুট কাপড় থেকেও সুতা তোলা যায়। কয়েক দিনের মধ্যে কাজটি বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করলেন। এবার বাড়ি ফিরে কাজ শুরুর পালা।
শুরু করলেন জুয়েল: নিজের আঙিনায় একটি চরকা বসালেন জুয়েল। ঝুট কাপড় থেকে নিজে সুতা তোলা শুরু করলেন। প্রথমে বড় ভাই আবদুর রাজ্জাক (৩০) ও ভগ্নিপতি মো. সাইফুলকে এই কাজ শেখালেন। শুরুর দিকে প্রতিবেশীদের তেমন আগ্রহ ছিল না। তাই তিনিই সুতা ছাড়ানোর চরকাসহ ঝুট কাপড় দিয়েছিলেন কয়েকজনকে। এঁরা সুতা জমা দিয়ে টাকা নেওয়া শুরু করলেন। দেখাদেখি অন্যরাও ধীরে ধীরে সুতা ছাড়ানোর কাজ যুক্ত হতে থাকলেন। একপর্যায়ে তা আশপাশের গ্রামের মানুষদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চাপড়ায় এখন রাজ্জাক ও সাইফুলই এই কাজ পরিচালনা করছেন। বছর তিনেক আগে জুয়েল শিবপুর (আলীপুর) গ্রামে তাঁর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে এই কাজ শুরু করেন। শ্বশুরের কোনো ছেলে না থাকায় তাঁর অনুরোধেই এই গ্রামে আসা। এই গ্রামেও তাঁর কাজ দেখে আশপাশের লোকজন আসেন শিখতে। জুয়েল জানান, তিনি ঢাকা থেকে গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় কেনেন প্রতি মণ ১ হাজার ৬০০ টাকা। এসব কাপড় থেকে সুতা ছাড়ানোর পর তা দিয়ে পাঁচ থেকে ছয় ধরনের রশি তৈরি হয়। প্রতি মণ রশি তিনি বিক্রি করেন ২ হাজার ৪০০ টাকা থেকে শুরু ৩ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
ব্যস্ত নারীরা: সুতা ছাড়ানোর কাজ করেন মূলত নারীরা। ঘরের কাজ শেষ করে অবসর সময়ে, কিংবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই কাজ করতে পারেন তাঁরা। তাই আলাদা করে সময় বের করতে হয় না।
শিবপুর (আলীপুর) গ্রামের দুই মেয়ের মা মজিদা খাতুন (৩০)। ১০ বছর আগে হঠাৎ স্বামী মারা গেলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাঁর। কাজ নেন অন্যের বাড়িতে। কিন্তু জীবন যেন চলে না। এমন সময় তাঁর জন্য অনেকটা আশীর্বাদ হয়ে জুয়েলের হাত ধরে গ্রামে এল এই সুতা ছাড়ানোর কাজ। ঘুরে দাঁড়ালেন মজিদা।
মজিদার মতো এই গ্রামগুলোর অনেক নারীর জীবনেই এমন কঠিন অভাবের গল্প রয়েছে। সুতা ছাড়ানোর কাজ শুরুর পর যা এখন তাঁদের কাছে অতীতের গল্প। আমাইল গ্রামের মাকসুদা (৩০), হরিরামপুর গ্রামের শিল্পী (২৫), চাকুলের মমিনা (৩২) জানান, সুতা তোলার কাজ করার আগে তাঁরা ঘর-গৃহস্থালি কাজ শেষে বাড়িতে অলস সময় কাটাতেন। অভাবমোচনের কোনো পথ ছিল না। এখন নিজেদের রোজগারের পথ খুঁজে পেয়েছেন। দুটো টাকার মুখ দেখছেন। এই নারীরা জানালেন, চরকায় এক কেজি সুতা তুলে জুয়েলের কাছে জমা দিলে ১৫ টাকা পান। দিনে একজন তিন থেকে চার কেজি সুতা তোলেন। এই কাজ করে গ্রামগুলোর অন্তত এক হাজার পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। সুতা ছাড়ানোর কাজের জন্য নারীদের বলতে গেলে কোনো বিনিয়োগই করতে হয় না। মাত্র এক শ টাকা দিয়ে একটি চরকা তৈরি করে নিলেই হলো। ঝুট কাপড় দেন জুয়েলই।
সুতা থেকে রশি: গ্রামগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ কেজি সুতা জমা হয় জুয়েলের কাছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি বিশেষ ধরনের যন্ত্র দিয়ে তিনিসহ ছয়জন এসব সুতা দিয়ে রশি তৈরি করেন। মোটা ও চিকন—দুই প্রকার রশি তৈরি করা হয়। মোটা রশি মূলত ট্রাকে ব্যবহারের জন্য তৈরি। দিনে চিকন রশি এক শ কেজির মতো তৈরি হয়। আর মোটা রশি তৈরি হয় দুই থেকে তিন শ কেজি। এসব রশি বিক্রি করে তিনি প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করেন। অনেক সময় ক্রেতারা তাঁর কাছ থেকে রশি কিনে নিয়ে যান। কখনো কখনো ক্রেতার চাহিদামতো তিনিই রশি পাঠিয়ে দেন।
সম্ভাবনা ও বাধা: জুয়েলের তৈরি রশি ঢাকা, কুষ্টিয়া, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। এসব রশির চাহিদাও রয়েছে। অনেক সময় চাহিদামতো রশি সরবরাহও করতে পারেন না জুয়েল। জানালেন, হাতে তৈরি যন্ত্র দিয়ে রশি তৈরি করতে বেশ সময় লেগে যায়। কম সময়ে বেশি রশি তৈরির জন্য উন্নত মেশিন বসানো গেলে এখানে আরও অনেক মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তাঁদের কথা: স্থানীয় জোতবানী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী মণ্ডল বলেন, ‘জুয়েল এলাকার অনেক পরিবারেই সচ্ছলতা এনেছেন। এলাকায় একটা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’ স্থানীয় শিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সভাপতি শাহাবুল ইসলাম বলেন, ‘জুয়েল এলাকার নারীদের কর্মসংস্থানের নতুন পথের সূচনা করেছেন। তাঁর হাত ধরে নারীদের কর্মসংস্থান আরও বাড়বে বলে আশা করছি।’

No comments

Powered by Blogger.