নিজের পায়ে কুড়াল মারার গণতন্ত্র! by সোহরাব হাসান

গত কয়েক দিনে পথে-ঘাটে, বাজারে-অফিসে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তাদের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে আমাদের রাজনীতিকদের কাজকর্মের কোনো মিল নেই। রাজনীতিকেরা জনগণের নামে রাজনীতি করলেও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে হাঁটতে পছন্দ করেন। এ কথা ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় পক্ষের জন্যই প্রযোজ্য। দেশের মানুষ চায় শান্তি, স্থিতি এবং সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলুক। রাজনীতিকেরা চান সংঘাত, হানাহানি। জনগণ চান জীবনের গতি এবং অর্থনীতির চাকা সচল থাকুক। কিন্তু রাজনীতিকেরা এমন সব কাজ করেন, যাতে সাধারণ মানুষ ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হয়। বাইরে গেলেই তাকে পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে মরতে হবে। ঘরেও তারা নিরাপদ নয়। সাংবাদিক সাগর-রুনি ঘরেই ছিলেন। তার পরও বাঁচতে পারেননি। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আহূত দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধের আজ ২৬তম দিন। স্বাধীনতার আগে ও পরে একনাগাড়ে এত দীর্ঘদিন দেশ অচল এবং মানুষকে জিম্মি করা কর্মসূচি পালিত হয়নি। একইভাবে বিরোধী দলের দাবির প্রতিও কোনো সরকার এতটা অবজ্ঞা ও অসূয়া দেখায়নি। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আলোচনাই উত্তম পথ। আলোচনা মানে প্রতিপক্ষের কাছে নতিস্বীকার নয়। আলোচনা মানে অন্যের কথা শোনা, নিজের কথা বলা। কিন্তু আমাদের অতি বিজ্ঞ রাজনীতিকেরা কেউ আলোচনায় বিশ্বাস করেন না। তাঁরা বিশ্বাস করেন ফটক বন্ধ রাখা ও ফটক বন্ধ করায়। ৫ জানুয়ারির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকার খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ফটক বন্ধ রেখেছিল পুলিশ, র্যাব ও ইট-বালুর ট্রাক দিয়ে। তারপর একসময় সেই ফটক খুলেও দেওয়া হয়। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার ছেলে মারা যাওয়ার পর যাতে শেখ হাসিনা তাঁকে সমবেদনা না জানাতে পারেন, সে জন্য বিএনপির নেতা-কর্মীরা সেই ফটক ফের বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই ফটক খোলা ও বন্ধ করার বিষয়টি যদি দলীয় নেতা-নেত্রীদের বাসা ও অফিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে আমাদের এতটা দুশ্চিন্তা করতে হতো না। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে এখন দেশের সব মানুষের অফিস ও ঘরের ফটক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অবরোধ-হরতালের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্দর-টার্মিনালের সব ফটক বন্ধ। বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে যে আভাস পাওয়া গেছে, তা হলো অবরোধ-হরতাল চলবে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। কত দিন? কত মাস? কত বছর? নেতাদের দাবি, বিরোধী দলের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। হয় জয়, না হয় মৃত্যু। খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, যত দিন বেঁচে থাকি জনগণের সঙ্গে থাকব। অবরোধ কর্মসূচি প্রলম্বিত করে জনগণকে জিম্মি করেই তিনি জনগণের সঙ্গে থাকতে চান। অবাক করা কাণ্ড হলো, বিএনপির এসব আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে তেমন প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। পত্রিকায় একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বললেই হলো কাল ১৪ জেলায় হরতাল, পরশু ১৫ জেলায়, আর হরতাল হয়ে গেল। কর্মীরা মাঠে নেই। নেতাদের কেউ আত্মগোপনে, কেউ ম্যাডামের সঙ্গে পরামর্শ করতে তাঁর গুলশান অফিসে হাজিরা দেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএনপির এসব কর্মসূচি নির্ধারণ ও কৌশল সম্পর্কে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই অবগত নন। ফলে কর্মসূচি ঘোষণা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতা প্রায়ই দৃশ্যমান হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে দলের একাধিক সিদ্ধান্ত সকালে ঘোষণার পর বিকেলে পরিবর্তন হয়েছে। আগের দিনের ঘোষণা পরদিন পাল্টে গেছে। গত বুধবার বিকেল পাঁচটায় বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে ঢাকাসহ (মহানগর ছাড়া) আশপাশের নয়টি জেলায় বৃহস্পতিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর দেড় ঘণ্টার মাথায় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আরেক বিবৃতি দিয়ে ওই দিন ঢাকা মহানগরে ভোর ছয়টা থেকে শুক্রবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা হরতালের ঘোষণা দেন তিনি। বিএনপি যথাসম্ভব দলীয় শক্তি কম ক্ষয় করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ক্লান্ত করার কৌশল অনুসরণ করে যাচ্ছে। (প্রথম আলো, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৫)।
বিএনপির দলীয় শক্তি কম ক্ষয় হলেও দেশের ও মানুষের শক্তি ক্ষয় হচ্ছে বেশুমার।
সরকারি মহলের দাবি, লন্ডনে বসে তারেক রহমান সব কলকাঠি নাড়ছেন। তাঁর নির্দেশেই জামায়াত-শিবির ও ছাত্রদলের ক্যাডাররা বাসে-ট্রাকে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মারছে। আন্দোলনের নামে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বরদাশত করা যায় না। এসব কঠোর হাতে দমন করা হবে। সরকারি দলের এক নেতাকে সবিনয়ে বললাম, সরকার তো মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। পারলে এতগুলো মানুষ পুড়ে মরত না। এত যানবাহন ধ্বংস হতো না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এবারে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ পত্রিকায় দেখলাম একজন মন্ত্রী বলেছেন, সরকার এখনো সন্ত্রাস দমনের সব হাতিয়ার ব্যবহার করেনি। প্রায় এক মাস ধরে দেশ অচল হয়ে আছে। শেষ হাতিয়ারটি তারা কবে ব্যবহার করবেন? নাশকতাকারীদের ধরতে মন্ত্রীরা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। আইজিপি পুরস্কার ঘোষণা করছেন। ডিএমপি কমিশনার পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। র্যাবপ্রধান পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তাঁরা বিষয়টিকে দেখছেন আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, এভাবে পুরস্কার ঘোষণা করে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করা যায় না। আলাপ প্রসঙ্গে সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা কোনো অবস্থায় বিরোধী দলের ‘অন্যায়’ দাবি মানবেন না। প্রয়োজনে আরও কঠোর হবেন। তাহলে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন? তাঁদের জবাব, এই আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। মানুষের সমর্থন নেই। গুপ্ত হামলা কিংবা বাসে আগুন দিয়ে আন্দোলন হয় না। তাঁরা মনে করেন, যতই দিন যাবে ততই বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কার্যকারিতা হারাবে, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। জানতে চাইলাম, আপনারা ৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়াকে জনসভা করতে দিলে তো বিএনপি লাগাতার কর্মসূচি দেওয়ার অজুহাত দেখাতে পারত না। খুব জোর দিয়ে না হলেও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট ওই কর্মসূচিকে ঘিরে বড় ধরনের নাশকতা করে সরকারের ওপর দায় চাপাত। আমি জিজ্ঞেস করি, খালেদা জিয়ার সাত দফা প্রস্তাবে তো নির্বাচনের দিনক্ষণ বেঁধে দেওয়ার কথা ছিল না। আপনারা কেন আলোচনায় রাজি হলেন না? তাঁদের সাফ জবাব, প্রধানমন্ত্রী তো নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে সংলাপে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন তিনি আসেননি। ট্রেন মিস করেছেন। এর জন্য তো আমরা দায়ী হতে পারি না। এখন বিএনপি আলোচনা চাইলে অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে আসতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা মনে করছেন, যতই দিন যাবে ততই পরিস্থিতি তাঁদের পক্ষে যাবে। সরকার স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় দেশ চালাচ্ছে। নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তার করছে। ভুয়া মামলায় বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিচ্ছে। এই অন্যায় মানুষ মেনে নেবে না। তারা রাজপথে নেমে আসবে। বিএনপি নেতাদের দাবি, বেসামরিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্য ও নিম্নস্তরের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁদের পক্ষে আছেন। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ কিছু বলছেন না। অবশ্য সরকারি দলের নেতারা এসব কথা আমলেই আনছেন না। তাঁদের মতে, কতিপয় দুষ্কৃতকারী ও বিপথগামী ছাড়া গোটা বাংলাদেশই তাঁদের সঙ্গে আছে। তবে আমরা নিশ্চিত নই। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিও এমনটি ভাবত। প্রায় এক মাস ধরে দেশ অবরুদ্ধ, দেশের মানুষ ও অর্থনীতি অবরুদ্ধ, শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি—সবই অবরুদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু নেতা-নেত্রীরা যে যাঁর অবস্থানে অনড়। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি প্রত্যাহার কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেই। দুই পক্ষই একে অন্যকে হেনস্তা করে গণতন্ত্রকে বিজয়ী করতে চাইছে। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ যে হেনস্তা হয়ে গেছে, সেটি কেউ মাথায় আনছেন না। ২৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে আমরা পাঁচ বছর ধরে কসরত করে আসছি। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পর নানা মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল যে নিজস্ব অর্থায়নে এটি সম্ভব কি না। কিন্তু গত ২৬ দিনে বণিক সমিতিগুলোর হিসাব অনুযায়ী, দেশ ৫২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছে। অর্থাৎ এই টাকা দিয়ে অনায়াসে দুটি পদ্মা সেতু করা যেত। একেই বলে নিজের পায়ে কুড়াল মারার গণতন্ত্র। আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে পারি, স্বৈরাচারকে উৎখাত করে বিজয় উৎসব করতে পারি, কিন্তু নিজেরা গণতান্ত্রিক আচরণ করতে জানি না। ২৪ বছরে দুই দলের ‘গণতান্ত্রিক শাসন’ সেটাই প্রমাণ করে।
বর্তমানে আমরা রাজপথে বিরোধী দলের যে জ্বালাও-পোড়াও এবং অবরোধ-হরতাল বন্ধের নামে সরকারের যে বেপরোয়া কাণ্ড দেখছি, সেটি অসুখ নয়, অসুখের উপসর্গ মাত্র। অসুখটা হলো সব রাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে গণতান্ত্রিকভাবে দেশ শাসন করতে না পারা। বিরোধী দলকে সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার প্রয়োগ করতে না দেওয়া। আমাদের দেশে বিজয়ী পক্ষ যেমন নির্বাচনের আগে জনগণকে দেওয়া অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দেশ চালায়, তেমনি পরাজিত পক্ষও হরতাল-অবরোধের নামে ‘বিকল্প শাসন’ ব্যবস্থা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা ভাবে, এবার ক্ষমতায় যেতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আর ক্ষমতাসীনদের চিন্তা হলো, যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে হবে, ক্ষমতা হারালেই সমূহ বিপদ। অথচ দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র থাকলে কারোরই ভয়ের কারণ ছিল না। নির্বাচন নিয়েও ৪৩ বছর ধরে আমাদের কাজিয়া করতে হতো না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.