সৌন্দর্যের বৃষ্টিবন by কামরুল আম্বিয়া

পোকা-মাকড়ের অদ্ভুত ঝিঁঝিঁ শব্দ, বিচিত্র সব পশুপাখির কিচিরমিচির, বানরের ভেংচি আর এক গাছ থেকে অন্য গাছে উল্লুকের ছোটাছুটি- এ হচ্ছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের চিরচেনা দৃশ্য। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী, লতাগুল্ম, হরেক রকম পাখি আর সবুজের হাতছানিতে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের এ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান দেশে ‘ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট’ হিসেবে খ্যাত। নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঝিঁঝিঁ পোকার অদ্ভুত একটানা শব্দ শুনতে শুনতে পর্যটকরা হারিয়ে যান প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ গহীন অরণ্যে। খুঁজে পান ব্যতিক্রমী আনন্দ। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যানটি পাখি ও উল্লুক দেখার জন্য শ্রেষ্ঠ আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশে অবশিষ্ট চিরহরিৎ বনের একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা। এটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বাংলাদেশের ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারন্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। পরিচিতির দিক থেকে সুন্দরবনের পরেই লাউয়াছড়া বনের অবস্থান। সিলেট বিভাগে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় এ বন অবস্থিত। সিলেট বিভাগের যতগুলো দর্শনীয় স্থান আছে তার মধ্যে পাহাড়ি এলাকাজুড়ে লাউয়াছড়া বৃষ্টিবন (রেইন ফরেস্ট) অন্যতম। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান মূলত শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের বনাঞ্চলের অংশ। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যানটি পশুপাখি দর্শনের জন্য দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান এবং উল্লুক দেখার জন্য শ্রেষ্ঠ উদ্যান। বৃহত্তর সিলেটের নয়নভুলানো এ উদ্যানটি সব সময় পর্যটকদের পদভারে থাকে মুখরিত। এ উদ্যানটিতে এখন শুধু পর্যটকদের বিনোদনেরই স্থান নয়, এ উদ্যানটি এখন জীবন্ত ও প্রাকৃতিক গবেষণাগারও  বটে। এখানে বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় হতে গবেষণার জন্য গবেষকরা আসছেন। সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেশ ভাল। তাই ছুটির দিনে নির্দ্বিধায় ভ্রমণপিপাসুরা চলে আসতে পারেন শ্রীমঙ্গলে।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তদানিন্তন ব্রিটিশ সরকার এখানে বৃক্ষায়ন করলে তা-ই বেড়ে আজকের এই বনে পরিণত হয়। মৌলভীবাজার ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীন ২,৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন ছিল এলাকাটি, সেই সুবাদে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পূর্ববতী নাম পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন। বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতি ভ্রমণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পশ্চিম ভানুগাছ বনের ১,২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। দেশের অন্যতম বৃহৎ বিনোদন স্পট ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গত কয়েক বছর থেকে রেকর্ডসংখ্যক দেশী-বিদেশী পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসুদের সমাবেশ ঘটছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারও রেকর্ডসংখ্যক বিনোদন পিপাসী মানুষ ছুটে আসেন চিরসবুজ এ বনের শ্যামল প্রান্তরে। শিক্ষা, গবেষণা, ইকো-ট্যুরিজমসহ ভ্রমণবিলাসীদের কাছে চিত্তবিনোদনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট হয়ে উঠেছে এ উদ্যান। দেশ-বিদেশের পশু-পাখিপ্রেমীরা এখানে ছুটে আসেন। কালের বিবর্তনে বদলে গেছে লাউয়াছড়ার সামগ্রিক চিত্র। নয়ন ভুলানো অন্যতম এ পর্যটন কেন্দ্রটি সারা বছর পর্যটকের পদভারে থাকে মুখরিত। ইউএসএইডের অর্থায়নে আইপ্যাক (সমন্বিত সংরক্ষিত এলাকা) সহায়তা প্রকল্পের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালনায় বাংলাদেশের যে  ৫টি অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যান রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও টেকনাফ জাতীয় উদ্যান। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিরসবুজ লাউয়াছড়ার পাহাড়ি বনাঞ্চল যেমনি জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তেমনি বনজ সম্পদের অমূল্য ভাণ্ডার। সেই সঙ্গে কনকনে শীত আর অঝোর ধারায় বৃষ্টি এখানকার  প্রকৃতিকে করেছে স্বতন্ত্র ও মধুময়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কি.মি. দূরে  দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়ার অবস্থান। শ্রীমঙ্গল থেকে রিজার্ভ গাড়ি অথবা বাসে আপনি আসতে পারেন এই গহীন বনাঞ্চলে।
এখানে আসার পথে রাস্তার দুই ধারে দেখতে পাবেন সবুজ শ্যামল চা-বাগান। উঁচু নিচু পাহাড়ে চা-বাগান দেখে মনে হবে যেন সমুদ্রের ঢেউ খেলছে। এখানে আরও রয়েছে পিকনিক স্পট ‘শ্যামলী’। সঙ্গে বন বিভাগের একটি বাংলো আছে। সেখানে পৌঁছে আপনি ইচ্ছে করলে হারিয়ে যেতে পারেন ঘন সবুজের গহীনে। দেখতে পাবেন বিচিত্র সব পশু-পাখি।  বনমোরগ, বানর, খড়গোশ, হনুমান, হরিণ, ভাল্লুক, চিতাবাঘ, সাপসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। এসব প্রাণী দেখতে বনের একটু গভীরে যেতে হবে। তবে প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা থাকায় ভেতরে যেতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। এ বনে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী উল্লুকের বসবাস। দুর্লভ এ প্রাণীটি বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মায়ানমার ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বর্তমানে ৬৯টি উল্লুক রয়েছে। অথচ আশির দশকেও উল্লুকের সংখ্যা ছিল তিন হাজারের মতো। উল্লুক ছাড়াও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যানে দেখা মেলে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পশুপাখির। অদ্ভুত এক নির্জন পরিবেশে অবস্থিত মিশ্র চিরহরিৎ এই পার্কে রয়েছে- ৪৬০ প্রজাতির জীব। যার মধ্যে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। তন্মধ্যে সেগুন, গর্জন, চাপালিশ, মেনজিয়াম, ডুমুর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রয়েছে ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী, ১৭ প্রজাতির দুর্লভ পোকা-মাকড় ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এদের মধ্যে মুখপোড়া হনুমান, কুলু বানর, শজারু, উল্লুক, হনুমান, লজ্জাবতী বানর, কালো ধনেশ, সাত ভায়ালা, লাল মাথা ট্রোগন, শ্যামা, অজগর, মেছোবাঘ, মায়া হরিণ, উদবিড়াল ও পাহাড়ি ময়নাসহ বিরল প্রজাতির পাখি ও বৃক্ষের অভয়াশ্রম এ লাউয়াছড়া।  এছাড়াও এ উদ্যানে ৮৫০ হেক্টর জায়গাজুড়ে দীর্ঘমেয়াদি বনায়ন, ১৭০ হেক্টর জায়গায় স্বল্পমেয়াদি বনায়ন, ২১ হেক্টরে বাঁশ ও বেত এবং ১৩০ হেক্টর জুড়ে পানচাষ, কৃষিজমি, বন গবেষণা এলাকা ও অন্যান্য অবকাঠামো রয়েছে।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত ৫-৬ বছর ধরে এখানে পর্যটকের সংখ্যা প্রতিবছর ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস-মাইক্রোবাসযোগে প্রতিদিন অগণিত মানুষের আগমন ঘটছে। শিশু-কিশোর-নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষ আসছেন লাউয়াছড়ায়। তবে শুক্র ও শনিবারসহ অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে আগত দর্শনার্থীদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। এ দিনগুলোয় ২ থেকে ৩ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। পারিবারিক পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা, অফিস, সংগঠন এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা সফরেও আসছেন এই জাতীয় উদ্যানে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গত বছর রেকর্ডসংখ্যক দেশী-বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটে। গহীন অরণ্যের নিস্তব্ধতা ভেঙে উল্লসিত মানুষের পদচারণায় সব সময় মুখরিত থাকে এই চিরসবুজ বন।
বাংলা উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে করা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ’ ছবিটির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এই লাউয়াছড়া বনে। ১৩টি দেশের ১১৪টি লোকেশনে চিত্রায়িত হয় ছবিটি। এসব দেশের মধ্যে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ভারত, বাংলাদেশ, স্পেন, থাইল্যান্ড ও জাপান। আর বাংলাদেশের অংশের শুটিং হয়েছিল রাউয়াছড়ার জঙ্গলে। বন ঘেঁষে যে রেলপথ চলে গেছে, ঠিক সেখানেই হয়েছে ছবিটির কিছু দৃশ্যের শুটিং। ছবিটির একটি দৃশ্য ছিল এ রকম- ট্রেন ছুটছে। হঠাৎ চালক খেয়াল করলেন, লাইনের সামনে একপাল হাতি আপনমনে চড়ে বেড়াচ্ছে। ট্রেন থেমে যায়। কামরা থেকে নেমে আসেন নায়ক ডেভিড নিভেন, ব্যাপারটা কি দেখতে। সামনের গ্রামেই তখন হচ্ছিল সতীদাহ। নায়ক ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে বাঁচান। মেয়েটি হলো শার্লি ম্যাক্লেইন। ছবির এই অংশটুকুই চিত্রায়িত হয়েছিল লাউয়াছড়ার রেল লাইন এলাকায়।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বব্যাপী বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত উল্লুক দেখার জন্য এ ‘রেইন ফরেস্ট’ একটি শ্রেষ্ঠ উদ্যান। পৃথিবীর যে চারটি দেশে উল্লুক দেখা যায় তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম এবং বাংলাদেশের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান উল্লুকের একক ও বৃহত্তম আবাসস্থল। পর্যটকদের সুবিধে বাড়াতে লাউয়াছড়ার ভৌগোলিক অবস্থান ও জীববৈচিত্র্যের ওপর স্থানীয় বেকার যুবকদের নিয়ে বেসরকারি সংস্থা ‘ক্রেল’ পরিবেশবান্ধব পর্যটন গাইড প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। লাউয়াছড়া বনে রয়েছে তিনটি প্রাকৃতিক ‘ফুট ট্রেইল’ বা পায়ে হাঁটা পথ। এরমধ্যে একটি ৩ ঘণ্টার, একটি ১ ঘণ্টার ও অপরটি ৩০ মিনিটের পথ। পর্যটকরা ইকো-ট্যুর গাইডের সাহায্য নিয়ে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে উদ্যানটি ঘুরে দেখতে পারেন। বিচিত্র এ প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, ইকো-ট্যুরিজম এবং শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এখন অদ্বিতীয়। পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে নির্মিত হয়েছে তথ্যকেন্দ্র, ইকো-কটেজ, ইকো-রেঁস্তোরা প্রভৃতি।
ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট ইকো-সিস্টেমস অ্যান্ড লাইভলিহুডস প্রজেক্ট (ক্রেল)’র শ্রীমঙ্গল ক্লাস্টার অফিসের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মাজহারুল ইসলাম জাহাঙ্গীর জানান, লাউয়াছড়ায় গত ৫২ মাসে পর্যটক এসেছে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫২৮ জন। এর মধ্যে বিদেশী পর্যটক ছিল ৬ হাজার ৬৪ জন। এ থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ ৯ হাজার ৩০ টাকা। ২০০৯ সালের ১লা নভেম্বর এ উদ্যানে প্রবেশ ফি চালু হওয়ার পর ছাত্রছাত্রী ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ১০ টাকা, প্রাপ্ত বয়স্কদের ২০ টাকা এবং বিদেশীদের জন্য ৫ ইউএস ডলার প্রবেশ ফি দিয়ে লাউয়াছড়ায় প্রবেশ করতে হয়। এছাড়া গাড়ি, জিপ, মাইক্রোবাস পার্কিংয়ের জন্য ২৫ টাকা, বনভোজনের জন্য জনপ্রতি ১০ টাকা এবং শ্যুটিং এলাকায় ১ দিনের জন্য ৬ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। প্রবেশ ফি চালুর পর গত ছয় বছরে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান আরও বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছে।

No comments

Powered by Blogger.