ইয়েমেনে রাজনৈতিক বিপর্যয় ও সালেহ-হাউছি জোট

বারো মাস আগেও ইয়েমেনের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আবেদ রব্বো মনসুর হাদি সানার রিপাবলিকান প্যালেসে বিদেশী কূটনীতিক ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের সামনে উপস্থিত হয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন যে, তার দেশ গণতন্ত্রের পথে রাজনৈতিক উত্তরণে ‘নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছে’। ২০১১ সালের আরব বসন্ত ইয়েমেনকে এক বিপর্যয়কর সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার হুমকি সৃষ্টি করে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের মধ্যস্থতায় যে চুক্তি হয় তাতে দেশটিতে যুদ্ধ রোধ হয়, দীর্ঘ দিনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ পদত্যাগ করেন এবং শান্তি আলোচনা ও নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয় হাদির ওপর। প্রাথমিকভাবে এই আলোচনা বিস্ময়করভাবে সফল হয়। কয়েক দশকের অস্থিতিশীলতার পর একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয় বলেই মনে হয়। তাই ২০১১ সালের গণবিক্ষোভে বিপর্যস্ত আরব দেশগুলোর জন্য ইয়েমেন আশার আলোয় পরিণত হয়। আটলান্টিক কাউন্সিলের দানিয়া গ্রিনফিল্ডের মতে, এ ধরনের খারাপ অবস্থা চলার পর এমন ঐকমত্য গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে একটি ‘উল্লেখযোগ্য সাফল্য’। তবে এখন কেউই আর আশাবাদী নন। এক সময় রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক আলোচিত ‘ইয়েমেনি মডেল’কে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার সঙ্কটের জন্য সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এটিকে এখন আর মেরামত করা সম্ভব নয়। রাজধানী সানা বর্তমানে সালেহ ও শিয়াপন্থী হাউছি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অনুগত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সালেহ একটানা ৩৩ বছর উত্তর ইয়েমেন শাসন করেন। প্রেসিডেন্ট হাদি গৃহবন্দী হওয়ার পরই পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এর কিছুক্ষণ পরই প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। দেশটির গোলযোগপূর্ণ দক্ষিণাঞ্চল উত্তরাঞ্চল থেকে কার্যকরভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এরই সুযোগে আলকায়েদার স্থানীয় শাখার পুনরুত্থান ঘটেছে। যারা ইয়েমেন পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখছেন তারা উত্তরণ প্রক্রিয়ার ব্যর্থতায় বিস্মিত হননি, এর বিরুদ্ধে সব সময়ই বড় ধরনের বাধা ছিল, তবে এ সরকারের ভেঙে পড়ার পেছনেও কারণ ছিল। এক সময়ের ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনপন্থী আন্দোলন হাউছি একটি সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত হয় এবং ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তারা রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে শুরু করে। ইয়েমেনিদের খুব কম লোকই ভেবেছিলেন যে, হাউছিদের হাতে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আছে এবং তারা রাজধানী সানায় রক্তাক্ত হামলা চালাতে পারে। বেশির ভাগ লোক মনে করেছিলেন, হাউছিরা শিগগিরই রাজধানী ছেড়ে যাবে। কিন্তু গত চার মাসে হাউছিরা উত্তর ও পশ্চিম ইয়েমেনে তাদের অধিকৃত এলাকার বৃদ্ধি করতে থাকে। এক সময়ের বৈরী সালেহর সহযোগিতায় হাউছিরা এটি করতে সক্ষম হয়। ২০১১ সালে তারই সরকার থেকে বের হয়ে যাওয়া রক্ষণশীল সুন্নি দলগুলোকে পরাজিত করতে সালেহ তাদের সাথে হাত মেলায়। আকস্মিকভাবে (হাউছি ও সালেহ) জোট গঠিত হয়। কারণ ২০০৪ সালে হাউছি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হোসাইন আল হাউছির মৃত্যুর জন্য তার সমর্থকেরা বহু বছর ধরে সালেহকেই দোষারোপ করে আসছিলেন। এখন তারা তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু এই জোট কি স্থায়ী প্রমাণিত হবে? সানার অতিসাম্প্রতিক সমস্যা হলো খসড়া সংবিধান। এর একটি ধারার বিরুদ্ধে দুই পক্ষই একই অবস্থান গ্রহণ করেছে। এতে একটি নতুন ফেডারেল সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। তবে হাউছি ও সালেহর মধ্যে আরো গভীর মতভেদ রয়েছে ইয়েমেনের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কেমন হবে তা নিয়ে। হাদি পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার আগ পর্যন্ত, সালেহর জেনারেল পিপলস কংগ্রেসের (জিপিসি) নেতৃত্বাধীন ইয়েমেনের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ হাদিকে অপসারণের জন্য ভোটাভুটির পরিকল্পনা করে। জিপিসি সদস্যরা পার্লামেন্টের স্পিকার ও সালেহর কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত ইয়াহিয়া আল রাইকে অন্তর্বর্তীকালীন নেতা নির্বাচন করতে চান। কিন্তু হাউছিরা তাদের নেতৃত্বে নতুন একটি সামরিক কাউন্সিল গঠনের দাবি জানান। তাদের শীর্ষস্থানীয় পলিটব্যুরো সদস্য আলি আল ইমাদ ২০০৩ সালে নির্বাচিত পার্লামেন্টকে ‘অবৈধ’ বলে অভিহিত করে বলেন, এই পার্লামেন্ট দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট হাদির পদত্যাগপত্র যদি গৃহীত হয়, এখনো তা না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে হাউছি ও সালেহর দল সঙ্ঘাতের পথ অনুসরণ করবে। দেশটির কট্টরপন্থী ক্ষমতার কেন্দ্র দু’টির পরস্পরের মধ্যে এমন কোনো আস্থা নেই, যা তাদের মধ্যে সঙ্ঘাত ঠেকাতে পারে। ইয়েমেনের সেনাবাহিনী গত চার বছরে নিঃশব্দে মুখ থুবড়ে পড়েছে।। পরিতাপের বিষয় হলো, ২০১৪ সালের শান্তি আলোচনায় যে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছিল তা এখন মরীচিকায় পর্যবসিত হয়েছে। ইয়েমেনের জনগণ স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার মতভেদ দূর করার স্বপ্ন দেখতে পেয়েছিলেন। এর পরিবর্তে এখন তারা নিজেদেরকে পরাজিত ও চরম বিপন্ন অবস্থায় নিপতিত দেখতে পাচ্ছেন। বিজয়ীরা সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, যা দেশকে চিরতরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়ার হুমকি সৃষ্টি করেছে। সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট

No comments

Powered by Blogger.