অভিমানে নিঃশব্দে চলে গেলেন by কাজী কাইয়ুম শিশির

গ্রিন পৌরাণিক কাহিনীর মানবদরদী প্রমিথিউস মানুষের কল্যাণের জন্য স্বর্গের আগুন চুরি করে পৃথিবীতে আনার অপরাধে দেবরাজ জিউস তাকে শৃঙ্খলিত করে ককেসাসের নির্জন চূড়ায় বেঁধে রাখে, যেখানে জিউসের ঈগল প্রতিদিন তার যকৃৎ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। দিন শেষে আবার রাতে তার যকৃৎ সৃষ্টি হয়ে যেত। এভাবে কিছু দিন চলার পর দেবরাজপুত্র হারকিউলিস সেই ঈগলকে বধ করে প্রমিথিউসকে মুক্ত করেন। বাংলাদেশের মানবদরদী প্রমিথিউস বেগম খালেদা জিয়া যখন স্বর্গের সেই মানবকল্যাণী আগুন নামক গণতন্ত্রকে ‘স্বর্গ থেকে ছিনিয়ে’ মানুষের মাঝে বিতরণের চেষ্টা করছেন, তখনই হিংস্র ঈগল তার যকৃৎ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করে। সমসাময়িক বিশ্বে এমনকি দূরঅতীতেও জিয়া পরিবারের মতো এমন সমন্বিত পরিবারের সংখ্যা খুবই সীমিত। শহীদ রাষ্ট্রপতি স্বামীর সুযোগ্য স্ত্রী হিসেবে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালনে চৌকস ভূমিকা পালনকারী বেগম জিয়ার ছেলে নিরহঙ্কার ও সরল মনের অধিকারী আরাফাত রহমান কোকোর অসময়োচিত বিদায় আমাদের ভাবিয়ে তোলে।
বিনয়ী, প্রচারবিমুখ কোকোর চরম শত্রুরাও তার ব্যক্তি চরিত্রের কোনো ত্রুটির কথা বলতে পারবেন না। সাধারণত রাজপরিবারের সদস্যদের যেসব চারিত্রিক স্খলন দেখা যায়; যেমনÑ মদ্যপান, ঘুষ, দুর্নীতি, অসৎ সঙ্গ, ব্যভিচার ইত্যাদির কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। সাধারণ জীবন যাপন করতেন। মায়ের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে কোনো কমিশন বাণিজ্য বা তদবির বাণিজ্যে তাকে কেউ দেখেনি। তৃতীয় বিশ্বের সরকারপ্রধানের সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের ভূরি ভূরি উদাহরণ থাকলেও কোকো ছিলেন নির্লোভ এবং এ সবের ঊর্ধ্বে।
খালেদা জিয়াকে ২০০৯ সালের ১৩ নভেম্বর তার বাসা থেকে উচ্ছেদের সময় কোকো মালয়েশিয়া ছিলেন। কোকোর বড়ই স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি। পুরো শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো তার এই বাড়িতে কেটেছে, এই বাড়ির প্রতিটি ধুলোবালি তার সাহচর্যের সাক্ষ্য দেয়। ছোটবেলায় প্রতিটি ঘরের আনাচে-কানাচে শিশু কোকোর সরব উপস্থিতি সবাইকে আবিষ্ট করে রাখত। লুকোচুরি তার ছিল প্রিয় একটি খেলা। বাড়ির ভেতরের আমগাছের ডালে লুকিয়ে সবাইকে অবাক করার মধ্য দিয়ে তার আনন্দের সীমা থাকত না। আজ সব কিছুই শুধু স্মৃতিÑ সেই কোকো আর তাদের প্রিয় ৬ নম্বর মইনুল রোডের বাড়িটি।
বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি, মা প্রধানমন্ত্রী। এমন বাবা-মায়ের ছেলে হিসেবে বেড়ে উঠলেও অমিতাচারে অবিশ্বাসী ও নম্রভদ্র কোকো শাব্দিক অর্থেই একজন সজ্জন স্বভাবের লোক ছিলেন। রাজনীতি নামক বেড়াজালে আবদ্ধ না হয়েই তিনি রাজনীতির কলঙ্কিত থাবায় আহত হয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে সাফল্য যার সোপান ছিল, কোনো দুষ্ট ক্ষতই তাকে চারিত্রিকভাবে কলঙ্কিত না করতে পারলেও রাজনৈতিক আক্রোশে তিনি ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। জিয়া পরিবারকে জানার ও বোঝার সৌভাগ্য হয়েছে আমার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই। নব্বই দশকের বেগম জিয়ার ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধায় ক্যান্টনমেন্টের ৬ নম্বর মইনুল রোডের বাসার দিকে আমার দৃষ্টিপাত। ক্ষমতায় থাকাকালে তার সেই বাসায় যাতায়াতের সুযোগ না হলেও, তার দুর্যোগের সময় অনেকবার যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। এই বাসাতেই বড় হয়ে ওঠা কোকোর সারল্য আমাদের দৃষ্টি কেড়েছিল। প্রচারবিমুখ এই কোকোকেই রাজনৈতিক খলনায়কেরা খালেদা জিয়াকে ঘায়েল করার জন্য দাবার ঘুঁটি হিসেবে শেষপর্যন্ত বেছে নেয়। ওয়ান-ইলেভেনের পর কুটিল রাজনীতির পাকচক্রে অরাজনৈতিক কোকোকে মইনুল রোডের বাসা থেকে নিয়ে যায় বেগম জিয়ার সাথে দর কষাকষির জন্য। উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ নেত্রীকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তাকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করা। তার মানসিক চাপ সহ্যের ক্ষমতা যাচাই করার জন্য পরদিন কোকোকে বাসায় ফেরত পাঠালেও, কয়েক দিন পর আবার এই রাজনীতিবিমুখ মানুষটিকে মা ও ভাইয়ের সাথে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জেলে যেতে হয়। কারাগারে অসুস্থ হলে ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই প্যারোলে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যান। ২০১১ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় দুই মেয়ে ও স্ত্রীসহ বসবাস শুরু করেন। বিদেশে থাকায় নিজেকে আদালতে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ লাভের আগেই তার ছয় বছরের জেল হয়ে যায়। দেশবাসী ও মায়ের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বহু দূরে অবস্থানকালে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৪ জানুয়ারি নীরবেই চলে গেলেন পরপারে।
তিনি অসময়ে চলে গেলেন দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে মাকে দুঃখের সাগরে রেখে। পুত্রশোকে মুহ্যমান মা খালেদা জিয়া যেন এখন দুঃখের অনলে পোড়া খাঁটি সোনা। রাজনৈতিক নিপীড়নের পাশাপাশি পারিবারিক শোক যেন বেগম জিয়াকে এক অসমসাহসী ত্যাগের প্রতীকে পরিণত করেছে। মাত্র ছয় বছরের মধ্যে মাতৃবিয়োগ, প্রিয় ভাইয়ের মৃত্যু, বাসায় অন্তরীণ ও এক বছরের বেশি জেলে থাকা, অফিসে অবরুদ্ধ জীবন এবং রাজনৈতিক চরম সঙ্কটের মধ্যেই ছোট ছেলে অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত হলেও দিশেহারা হননি। আমাদের আশা, বাংলাদেশের প্রমিথিউস খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের সেই আগুনটি ছড়িয়ে দেবেন ঘরে ঘরে। জন্ম নেবে নতুন গণতান্ত্রিক ধারার বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.