আগুনে নিভে গেল ১৩ প্রাণ- মিরপুরে সনি সিনেমা হলের সামনে প্লাস্টিক কারখানায় বিস্ফোরণ

(রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর সেকশনে গতকাল বিকেলে প্লাস্টিক কারখানায় আগুনে মারা যাওয়া একজনের লাশ বের করে আনেন উদ্ধারকর্মীরা l ছবি: প্রথম আলো) রাজধানীর মিরপুরে গতকাল শনিবার বিকেলে একটি প্লাস্টিক কারখানায় বিস্ফোরণের পর আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ১৩ জন। আহত হন অন্তত তিনজন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। আগুনে পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে লাশ। তাঁদের মধ্যে তিনজনের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে বলে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। তাঁরা হলেন কারখানার মালিকের ব্যবসায়িক অংশীদার তাসবীর হাবিব (৩০), হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বাচ্চু মিয়া (৪৫) ও পিয়ন রাশিয়া বেগম (৫০)। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিরা হলেন কারখানার নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক তৌহিদুল ইসলাম (৫০), নিরাপত্তাকর্মী কামাল হোসেন (৩৫) ও কারখানার শ্রমিক রবিউল ইসলাম (৩৫)। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, কারখানাটির মালিকের নাম আনিসুজ্জামান খান বলে জানা গেছে। ওই কারখানায় ব্রয়লার, গ্যাস সিলিন্ডারসহ দাহ্য পদার্থ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে ব্রয়লার বা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর পুরো কারখানায় আগুন লেগে যায়। সরেজমিনে জানা যায়, ‘অ্যাপকো বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামের চারতলা ভবনের কারখানাটি মিরপুর ১ নম্বরে সনি সিনেমা হলের বিপরীত পাশে অবস্থিত। কারখানাটিতে প্লাস্টিক ও ফোমের মিশ্রণে একবার ব্যবহার উপযোগী খাবারের প্যাকেট, গ্লাস, প্লেটসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী তৈরি করা হয়। গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে কারখানাটির নিচতলায় বিকট শব্দে দুটি বিস্ফোরণ হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন আর কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো ভবন। ওই সময় ভবনে থাকা লোকজন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। কেউ ভবন থেকে দৌড়ে বের হয়ে, কেউ ছাদে উঠে পাশের সংযুক্ত ভবনের ছাদে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। ঘটনার পর আশপাশের ভবন ও বাসাবাড়িতেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে যান। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভেতর থেকে ১৩টি লাশ বের করে আনেন বলে শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিমুজ্জামান নিশ্চিত করেছেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, মনে হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন ধরার পর ব্রয়লার বা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে তা ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের ভেতরে দাহ্য পদার্থ বেশি থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্লাস্টিকের গৃহস্থালি বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির ওই কারখানায় অনেকগুলো গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। বিস্ফোরিত গ্যাস সিলিন্ডারও সেখানে দেখা গেছে। এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ঘটনাস্থলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান চুন্নু সাংবাদিকদের জানান, এ ঘটনায় কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সন্ধ্যায় দেখা যায়, ওই ভবনে পাইপ দিয়ে পানি ছিটাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আশপাশে উৎসুক জনতার ভিড়। ধোঁয়া-আগুনে প্রায় কালো হয়ে গেছে পুরো ভবন। ভবনের ভেতরে বিভিন্ন সরঞ্জাম পুড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে কারখানাটির মেশিন অপারেটর মো. মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চারতলায় চেয়ারে বইসা ছিলাম। হঠাৎ দুইটা জোরে শব্দ হইল। কয়েক সেকেন্ড পর দেখলাম, নিচ থেইকা আগুন আর ধোঁয়া ওপরের দিকে আইতাছে। আমি তাড়াতাড়ি ছাদে যাই। পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে লাফ দিয়ে বাইর হইয়া গেলাম।’ মামুন জানান, কারখানায় সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা এবং রাত ১০টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত দুই পালায় কাজ চলে। পণ্য উৎপাদন, হিসাবরক্ষণ ও বিপণনের কাজ চলে এই ভবনে। গতকাল সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া পালায় ২২ জন পুরুষ ও ১০ জন নারী কর্মরত ছিলেন। গতকাল সাভার থেকে পিকআপ ভ্যানে করে ভবনের নিচতলায় কাঁচামাল আনা হয়। পিকআপ ভ্যানটির সহযোগী মো. সজীব প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচামাল নামানোর পর গাড়ি বের করার সময় হঠাৎ দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ধেয়ে এসে তাঁদের গাড়িতে লাগে। তিনি ও চালক দৌড়ে ভবন থেকে বের হয়ে আসেন। দেখেন, আগুনে দগ্ধ হয়ে বের হয়ে আসছেন দুই নিরাপত্তাকর্মীসহ তিনজন। কারখানাটির সামনে কিছুটা দূরে ‘আমার ভাই ভিতরে আছে’ বলে আহাজারি করছিলেন এক যুবক। জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন আরেকজন। আহাজারি করতে থাকা যুবকের নাম মো. শিপন। তাঁর বড় ভাই বিল্লাল হোসেন ওই কারখানায় চাকরি করেন। ঘটনার পর থেকে তাঁর ফোন বন্ধ। শিপনের মতো স্বজনদের খোঁজে ভবনের সামনে ছুটে গেছেন অনেকেই। কেউ কেউ নিয়ে এসেছেন ছবি। বোনের খোঁজে এসেছেন মোছাম্মৎ লাকী। কাঁদতে কাঁদতে সাংবাদিকদের বললেন, তাঁর ছোট বোন শবনম পারভীন কারখানায় হিসাব শাখায় কাজ করেন। তাঁকে খুঁজে পাচ্ছেন না। ফোন বন্ধ। রাতে শাহ আলী থানার পুলিশ ১৩টি লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যায়। স্বজনেরা লাশগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে শনাক্তের চেষ্টা করেই যাচ্ছিলেন। এক নারী লাশের পায়ে ছিল নূপুর। পুড়ে তা কালো হয়ে গেছে। মুঠোফোনে সেই নূপুরের ছবি তুলছিলেন এম এ কাদের। তিনি সাংবাদিকদের জানান, তাঁর শ্যালিকা ঈশিতা ওই কারখানায় চাকরি করেন। তাঁর খোঁজ পাচ্ছেন না। ইশিতা নূপুর পরতেন। নূপুর দেখে চেনা যায় কি না তা দেখার জন্য একজনের মারফত মুঠোফোনের ছবিগুলো তাঁর বোনের কাছে পাঠানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.