রোড নম্বর ৮৬ by কাজী সুমন

‘খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ, আমরা অবরুদ্ধ নই। আমাদের কেন হয়রানি করা হবে। বারবার জিজ্ঞাসাবাদের নামে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। আমাদের কি অপরাধ?’- এভাবেই পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদ করছিলেন গুলশান-২ এর ৮৬ নম্বর সড়কের পার্ক অ্যাভিলা (৭-বি) অ্যাপার্টমেন্টের ডি-৩ ইউনিটের বাসিন্দা রিয়া। দীর্ঘ ১১ দিন ধরে প্রতিনিয়তই রিয়ার মতো ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ৮৬ ও ৮৮ নম্বর সড়কের অর্ধশতাধিক পরিবার, একটি স্কুল, একটি দূতাবাস ও একটি তেল-গ্যাস কোম্পানির অফিসের কর্মকর্তারা। এমনকি ওই রোডের অ্যাপার্টমেন্টে বেড়াতে আসা আত্মীয়স্বজনরাও শিকার হচ্ছেন হয়রানির। তাদের বাসায় ঢুকতে যেমন পুলিশের অনুমতি লাগে তেমনি বের হতেও লাগে অনুমতি। এতে প্রতিনিয়তই পুলিশের সঙ্গে তাদের ঘটছে বাকবিতন্ডা।
৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়িটি বিরোধী জোটের শীর্ষনেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়। গত ৩রা জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় দলীয় কাজ সারতে ওই কার্যালয়ে আসেন তিনি। এর পরপরই ওই সড়কের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে পুলিশি তল্লাশি চৌকি বসানো হয়। খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে রাস্তার দু’দিকে জলকামান, পুলিশভ্যান আড়াআড়িভাবে রেখে ব্যারিকেড দেয়া হয়। ওই সড়কের সাধারণ জন ও যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে খালেদা জিয়ার মতো কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন ওই সড়কের বাসিন্দারাও। প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা। গত সোমবার রাতে অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলেন রিয়া। ৮৬ নম্বর সড়কের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথে ঢুকতেই তার পথ রোধ করে পুলিশ। পার্ক অ্যাভিলা অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা বলার পরও পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখানোসহ নানা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। এসময় তিনি এই হয়রানির প্রতিবাদ করেন। পুলিশের উদ্দেশে রিয়া বলেন, খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ হতে পারেন। আমরা তো অবরুদ্ধ নই। আমাদের কেন এই হয়রানি করা হচ্ছে। আমাদের কি অপরাধ? অ্যাভিলা অ্যাপার্টমেন্টটিতে বসবাস করছে ৩৪টি পরিবার। ওই অ্যাপার্টমেন্টে গৃহকর্মীর কাজ করেন আছিয়া বেগম। গত মঙ্গলবার সকালে ওই অ্যাপার্টমেন্টে যেতে চাইলে বাধা দেয় পুলিশ। পরিচয় দেয়ার পরও দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তাকে। এসময় পুলিশের সঙ্গে তুমুল তর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। গৃহকর্মী আছিয়া বলেন, আমি পেটের দায়ে ওই বাসায় কাজ করি। আমাকে প্রতিদিন বাধা দেন কেন? আমরা তো আন্দোলন করতে আসিনি। প্রায় ১০ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখার পর ঢুকতে দেয়া হয় তাকে। ওই অ্যাপার্টমেন্টের ই-৩ ইউনিটের বাসিন্দা মো. শাহজাহান বলেন, আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। আমাদের তো আর কিছু করার নেই। পুলিশের এই ভোগান্তি মেনে নিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে। আমরা তো আর প্রতিবাদ করতে পারছি না। এসময় তিনি রসিকতা করে বলেন, একদিকে ভালই হয়েছে। পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। আমরা পুলিশি নিরাপত্তা বলয়ে আছি। বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের দক্ষিণ দিকের বাড়িটি (৬-বি) জাতীয় পার্টির এমপি আলহাজ কাশেম আলীর। ওই বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষী মো. রাসেল জানান, গায়ে ইউনিফর্ম থাকার পরও পুলিশ আমাদের ঢুকতে বাধা দেয়। এছাড়া, প্রায় সময় বাসার জন্য বাজার করতে হয়।
এসময় পুলিশকে বলে যাওয়ার পরও ঢোকার সময় তারা হয়রানি করে। তিনি আরও বলেন, এমপি কাশেম আলীর ভায়রা হলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। গত রোববার বোনের বাসায় বেড়াতে যান ইকবাল সোবহান চৌধুরীর স্ত্রী। কিন্তু ৮৬ নম্বর সড়কের দক্ষিণদিকের পুলিশি তল্লাশির মুখে পড়তে হয় তাকে। পরিচয় দেয়ার পর প্রায় কয়েক মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখা হয় তার গাড়ি। বাসার ভেতর থেকে গিয়ে পুলিশকে বলার পর তাকে প্রবেশ করতে দেয়। এদিকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের পশ্চিমদিকে রয়েছে গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী ওই প্রতিষ্ঠানটিতে পড়াশোনা করে। মঙ্গলবার বেলা ২টায় গিয়ে দেখা যায়, স্কুলটিতে ছাত্রছাত্রী নেই। শিক্ষকরাও প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে চলে গেছেন। গেটে পাহারা দিচ্ছেন নিরাপত্তা রক্ষী আমান আলী। তিনি বলেন, অবরোধ আর পুলিশের ব্যারিকেডের জন্য ছাত্রছাত্রী আসে না। অল্পকিছু ছাত্রছাত্রী আসে। তাই ক্লাস হয় না। স্যাররা দুপুরের আগেই স্কুল ছুটি দিয়ে চলে গেছেন।
খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের উত্তরদিকের অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করে ১০টির মতো পরিবার। এরপর বাড়িটি হলো এক ব্যবসায়ীর। এছাড়া, ৮৬ নম্বর রোডের উত্তরের এক নম্বর বাড়িটি হলো কিংস পার্ক নামে একটি অ্যাপার্টমেন্ট। ওই অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করে পাঁচটি পরিবার। ৩রা জানুয়ারি রাতে বালু ও ইটভর্তি ট্রাকের ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিল ওই সড়কের সর্ব উত্তরদিকে। এতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন ওই তিনটি বাড়ির বাসিন্দারাও। গাড়ি নিয়ে কেউ বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি, কিংবা ঢুকতেও পারেননি। ৬ই জানুয়ারি বালুর ট্রাক সরিয়ে নেয়ার পর পুলিশি নিরাপত্তা কিছুটা শিথিল করা হয়। এরপর পুলিশি ব্যারিকেড কিছুটা দক্ষিণদিকে সরিয়ে আনা হয়। এতে কিছুটা স্বস্তি পান ওই তিনটি বাড়ির বাসিন্দারা। এদিকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের উত্তর-পূর্বদিকের গলিটি হলো ৮৮ নম্বর রোড। কার্যালয়ের পূর্বদিকের বাড়িটি হলো একটি তেল-গ্যাস কোম্পানির অফিস। এর উল্টো দিকের বাড়িটি হলো থাই দূতাবাসের ভিসা প্রসেসিং কার্যালয়। প্রতিদিনই শতাধিক মানুষ নিরাপত্তার বিড়ম্বনা পেরিয়ে দূতাবাসে আসেন। গত মঙ্গলবার দুপুরে দূতাবাসে ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজে আসেন সোলায়মান নামের এক যুবক। এসময় ৮৬ নম্বর সড়কের উত্তরদিক দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে আসতে চাইলে পুলিশ তাকে বাধা দেয়। এসময় তিনি থাই দূতাবাসে যাওয়ার কথা জানালে পুলিশ তাকে যাওয়ার অনুমতি দেয়। কিন্তু মোটরসাইকেলটি ব্যারিকেডের বাইরে রেখে দীর্ঘপথ হেঁটে দূতাবাসে যেতে হয়। ৮৮ নম্বর রোডে (হোল্ডিং নং ৩ ও ৩-বি) দুটি বাড়ি রয়েছে। তারা নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এই হয়রানির ব্যাপারে ৮৬ নম্বর রোডের তল্লাশি চৌকিতে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য হাসমত আলী জানান, মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং পরিচয় জেনে ঢুকতে দেয়া আমাদের কর্তব্য। অপরিচিত কেউ ঢুকে কোন ধরনের অঘটন ঘটালে এর দায় আমাদের ওপর বর্তাবে। এছাড়া, প্রতিদিনই নতুন নতুন পুলিশ সদস্যরা ডিউটি করেন। প্রতি ১২ ঘণ্টা পর আমাদের ডিউটি পরিবর্তন হয়। তাই প্রতিদিন অ্যাপার্টমেন্টের লোকজন যারা চলাচল করেন তাদের আমরা চিনি না। তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের নিরাপত্তা সমন্বয়কারী গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ কবির জানান, নিরাপত্তার স্বার্থে অপরিচিতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। কাউকে হয়রানি করা হয়নি। বাসার লোকজনকে হয়রানির অভিযোগ সঠিক নয় বলেও দাবি করেন তিনি।
অবরুদ্ধ খালেদার ১১ দিন
গুলশানের নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘ ১১ দিন পার করেছেন বিরোধী জোটের শীর্ষনেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ৮৬ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়ির দোতলায় সীমাবদ্ধ তার চলাচল। নাওয়া-খাওয়া, বিশ্রাম সারছেন কার্যালয়টিতেই। এদিকে গতকালও কার্যালয়ের সামনের রাস্তার দুদিকে জলকামান ও পুলিশভ্যান আড়াআড়িভাবে মোতায়েন রয়েছে। ওই সড়কের দুদিকে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারা। কার্যালয়ের সামনে মোতায়েন রয়েছে অর্ধশতাধিক নারী পুলিশ। ওই সড়কে বন্ধ রয়েছে সাধারণ মানুষ ও যান চলাচল। এদিকে বেলা ১২টার দিকে গুলশান কার্যালয়ে যান মহিলা দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি ডা. নূর জাহান মাহবুবের নেতৃত্বে ৬ জন মহিলা নেত্রী। আধা ঘণ্টা পর কার্যালয় থেকে বেরিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের নূর জাহান মাহবুব বলেন, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) সুস্থ আছেন। গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আদায়ে যে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে সে দাবি অ?াদায় না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে মহিল?া দলের নেত্রী মনি বেগম, শামসুর নাহার, সাজেদা আলী হেলেন, শিরীন জাহান এবং রোকেয়া সুলতানা উপস্থিত ছিলেন। ওদিকে বেলা ১টার দিকে খাবার নিয়ে কার্যালয়ে যান বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মেহেরুন্নেসা হক, মহিলা নেত্রী সুরাইয়া বেগম, আসমা আরেফিন, হুসনে আরা চৌধুরী এবং মরিয়ম বেগম। ওদিকে রাতে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান বিএনপি চেয়াপারসনের উপদেষ্টা এড. এজে মোহাম্মদ আলীসহ দলের আইনজীবী তিন নেতা। অপর দুই নেতা হলেন- দলের সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক এড. নেতাই রায় চৌধুরী ও এড আসাদুজ্জামান। কার্যালয় থেকে বেরিয়ে এজে মোহাম্মদ আলী উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে আইনগত বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করতে এসেছিলাম। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। উল্লেখ্য, ৩রা জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে আসার পর কার্যালয়ের সামনে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলে পুলিশ। অর্ধশতাধিক নারী পুলিশ সদস্যকে মোতায়েন করা হয় কার্যালয়ের সামনে। কার্যালয়ের সামনের রাস্তার দক্ষিণ পাশে একটি জলকামান ও পুলিশ ভ্যান ও উত্তর পাশে আরেকটি জলকামান ও পুলিশ ভ্যান দিয়ে ব্যারিকেড। নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অসুস্থ দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ দেখতে যেতে রওনা হলে বিএনপি চেয়ারপারসনের পথরোধ করে পুলিশ। প্রায় আধাঘণ্টা গাড়িতে বসে থেকে ফের কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন তিনি। পূর্ব ঘোষিত ৫ই জানুয়ারির সমাবেশে যাওয়া ঠেকাতে ওই রাত ১২টার পর থেকেই একে একে কার্যালয়ের সামনের রাস্তার দুইপাশে এনে রাখা হয় ১১টি ইট ও বালুভর্তি ট্রাক। এরপর থেকেই কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনবারের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ৫ই জানুয়ারি বেলা ১২টার দিকে কার্যালয়ের তিনটি ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। ওইদিন বিকালে কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে পেপার সেপ্র নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশি বাধা পেয়ে গেটেই দাঁড়িয়েই সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা তিনি। পরদিন বালুর ট্রাক সরানো হলেও ব্যারিকেড সরানো হয়নি। এরপর থেকেই দলীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ জীবন যাপন করছেন তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.