রিয়াজ রহমানের অবস্থা স্থিতিশীল

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানকে গুলি ও তার গাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। গতকাল রাত পর্যন্ত এ ঘটনায় সন্দেহভাজন কাউকে শনাক্ত বা আটক করতে পারেনি পুলিশ। তবে এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করা হয়েছে ঘটনাস্থলের পাশে থাকা সিসি ক্যামেরা থেকে। ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রিয়াজ রহমানের অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া রিয়াজ রহমানের চিকিৎসায় ইউনাইটেড হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, রিয়াজ রহমানকে গুলির ঘটনায় গতকাল সকালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি’র ক্রাইম সিন দলের সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা এ সময় ঘটনাস্থল থেকেও কিছু আলামত সংগ্রহ করেন। পরে তারা আগারগাঁওয়ের ডাম্পিং স্টেশনে রিয়াজ রহমানের পুড়ে যাওয়া গাড়ি থেকে আলামত সংগ্রহ করেন। ঘটনার পরপরই পুলিশ রিয়াজ রহমানের পুড়ে যাওয়া প্রাইভেট কারটি রেকার দিয়ে আগারগাঁওয়ের ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে রাখে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার পর তারা রিয়াজ রহমানের পরিবারের সদস্যদের থানায় মামলা করতে বলেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করলে গতকাল বিকালে পুলিশ বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা করে। মামলা নম্বর-২২। মামলায় অজ্ঞাতনামা একদল যুবককে আসামি করা হয়েছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, একদল যুবক গুলশানের ৪৬ নম্বর সড়কে রিয়াজ রহমানের গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন দেয় এবং তাকে গুলি চালিয়ে আহত করে। এদিকে পুলিশ মামলার কথা জানালেও মামলার বাদীর নাম জানাতে পারেনি।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রিয়াজ রহমানকে গুলির ঘটনাটি তদন্ত করতে তারা তার পরিবারের সদস্যের সহযোগিতা চেয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা রিয়াজ রহমানের গাড়িচালকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা তার চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় চালকের সঙ্গেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এদিকে রিয়াজ রহমানকে ইউনাইটেড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। গতকাল বিকালে তার অস্ত্রোপচার করা হয়। এর আগে দুপুরে রিয়াজ রহমানের শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে পরিচালক (ক্লিনিকেল অপারেশন) ডা. দবির উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, তার কোমরের বাঁ দিকের পেছনে দুটি ও বাঁ হাঁটুর নিচের দিকে দুটি ক্ষত রয়েছে। গুলি ঢোকার প্রতিটি স্থানে দেড় সেন্টিমিটার গভীর ক্ষত হয়েছে এবং সেখানটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। আর গুলি বেরোনোর জায়গায় দুই সেন্টিমিটার গভীর ক্ষত হয়েছে। সিটিস্ক্যান ও এমআরআই প্রতিবেদনে কোন ধাতব (মেটালিক) বস্তু দেখা যায়নি জানিয়ে চিকিৎসক বলেন, তবে নরম ও স্নায়ু পেশিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার বাঁ পায়ের গোড়ালি ফোলা ও ফুট ড্রপ দেখা গেছে। তার বাঁ পায়ের অনুভূতি কম, তিনি পা নাড়াচড়া করতে পারছেন না। রিয়াজ রহমানের শরীরে গুলি রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আগমন-নির্গমন ক্ষত আছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, রিয়াজ রহমানের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কামুক্ত মনে হলেও তার পা নিয়ে চিন্তিত সবাই। পা সচল করার জন্য চিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন।
এদিকে রিয়াজ রহমানের চিকিৎসায় গতকাল সকালে অর্থোপেডিকস বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন সার্জারি বিভাগের বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে এম জাফরুল্লাহ সিদ্দিক, নিউরোমেডিসিনের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল ইসলাম, মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ মো. ইকবাল হোসেন ও অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ।
রিয়াজ রহমানের সঙ্গে হাসপাতালে তার স্ত্রী নার্গিস রহমান, মেয়ে আমেনা রহমান ও ছোট ভাই ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এম ওমর রহমান সার্বক্ষণিক রয়েছেন। এ ছাড়া ঘটনার পর থেকেই বিএনপি নেতা ও সাবেক কূটনীতিকরা হাসপাতালে তাকে দেখতে যান। গতকাল রিয়াজ রহমানকে দেখতে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ, সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এম সাইদুজ্জামান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক আহমেদ চৌধুরী, ফারুক সোবহান, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ জমির, সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী, রুহুল আলম চৌধুরী ও এস এম রাশেদ আহমেদ হাসপাতালে যান।
রিয়াজ রহমানকে গুলির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মাহবুবুর রহমান বলেন, রিয়াজ রহমানের মতো একজন কূটনীতিকের ওপর এভাবে হামলার ঘটনায় বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে। এটা কোনভাবে কাম্য নয়। আমরা এ রকম ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। সন্ধ্যায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও তাকে দেখতে যান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তিনি এখনও আশঙ্কামুক্ত নন। রাজনীতিতে তার মতো একজন সজ্জন ও ভদ্রলোকের ওপর হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আমি দুষ্কৃতকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার: তিনটি মোটরসাইকেলে ৮ জন যুবক সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানকে বহনকারী প্রাইভেট কার অনুসরণ করছিল। গুলশান ২-এর ৫৪ নম্বর সড়কের কাছে এসে মোটরসাইকেল দিয়ে গাড়ির গতিরোধ করে। গুলশানের ৫৪ নম্বর সড়কে একটি বহুতল ভবনের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে এ দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন তদন্তকারী পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তবে ভিডিও ফুটেজে এ দৃশ্য ঝাপসা বলে জানিয়েছেন। ঘটনাস্থলে আলোর স্বল্পতার কারণে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজের দৃশ্য অস্পষ্ট হয়েছে। সিসি ক্যামেরা থেকে ঘটনাস্থল অন্তত ১৮ ফুট দূরে বলে জানা গেছে।
গুলশানের ৫৪ নম্বর সড়কে ডরিন টাওয়ারের দুটি সিসি ক্যামেরা থেকে দুটি ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করা হয়। সিসি ক্যামেরার এ দৃশ্য পর্যালোচনা করে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনটি মোটরসাইকেলে ৮ জন যুবক ছিল। এদের প্রত্যেকের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত। ভিডিও ফুটেজে ওই যুবকদের মুখ স্পষ্ট নয়। একপাশ থেকে ভিডিও ফুটেজ হওয়ায় চেহারা স্পষ্ট নয়।
হামলাকারীদের গ্রেপ্তার দাবি মওদুদের
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। রাত পৌনে ৮টার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রিয়াজ রহমানকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের মাধ্যমে তিনি এ দাবি জানান। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, এটি একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। এর আগে তিনি রিয়াজ রহমানের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন।
হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ নানা মহলের
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর গুলিবর্ষণ ও তার গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। গতকাল দলের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে তিনি এ প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় প্রকাশ্য রিয়াজ রহমানের মতো একজন সজ্জন ব্যক্তির ওপর এরকম আক্রমণ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভঙ্গুর অবস্থারই নিদর্শন।  অবিলম্বে দোষীদের গ্রেপ্তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে জোর দাবি জানান তিনি। এদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, সোহরাওয়ার্দীর জনসভায় চরম উস্কানিমূলক বক্তব্যের পরপরই রিয়াজ রহমান গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গুলশানে পুলিশ-র‌্যাবের নিবিড় নিরাপত্তা বেষ্টনীতে কারা গুলি চালায়, কারা গাড়িতে আগুন দেয়- এটা জানা ও বোঝার জন্য সাধু-সাক্ষীর প্রয়োজন হয় না। জোটের আরেক শরিক দল লেবার পার্টির সভাপতি ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, রিয়াজ রহমানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করতেই সরকারের এজেন্টরা গুলি করে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। খালেদা জিয়ার দেশরক্ষার সংগ্রামে বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত করতেই শমসের মবিন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার, সাবিহউদ্দিন আহমেদের গাড়িতে আগুন ও রিয়াজ রহমানকে গুলি করে হত্যা করতে চেয়েছে। এনডিপি চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকার তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য হত্যার উদ্দেশে সাবেক প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর গুলিবর্ষণ করেছে। এর আগেও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে সন্ত্রাসীরা গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহউদ্দিন আহমেদের গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন শত নাগরিক রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ ও হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান জেবা আহমেদ খান ও মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসা এক যৌথ বিবৃতিতে রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের কার্যকরী সভাপতি মাঈনুদ্দিন খান বাদল উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার পর রিয়াজ উদ্দিনের হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাই বাদলকে গ্রেপ্তার করলেই হামলাকারীদের নাম প্রকাশ হবে।

No comments

Powered by Blogger.