চলন্ত বাসে পেট্রলবোমা, নিহত ৫- পুলিশ–বিজিবির পাহারার মধ্যেই হামলা, দগ্ধ ১১

(দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ছে জিপ, গতকাল বেলা একটায় রাজধানীর মিরপুর রোডে সানরাইজ প্লাজার সামনে l ছবি: প্রথম আলো) সামনে পুলিশ আর পেছনে বিজিবির গাড়ি। মাঝে ৩০টি যাত্রীবাহী বাস ছুটছিল ঢাকার দিকে। এ রকম কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই একটি চলন্ত বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারা হয়। মুহূর্তেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে বাসটি। ঘটনাস্থলেই পুড়ে মারা যায় এক শিশুসহ চারজন। দগ্ধ হয় আরও ১২ জন। তাঁদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান আরও একজন। বিভিন্ন হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন বাকি ১১ জন। নৃশংস এ ঘটনাটি ঘটেছে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের মিঠাপুকুরে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সাতজনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্য তিনজন রংপুর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে নৃশংস এ ঘটনা ঘটল। অবরোধের সমর্থকেরা বাসে পেট্রলবোমা ছুড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় নয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। তাঁদের একজন শিবিরের কর্মী।
নিহত ব্যক্তিদের একজন ছাড়া সবার বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুরে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন বিজয় তাবোগপুর গ্রামের রহিমা বেগম (৬০), তাঁর ছেলে রহিম বাদশা (৩৭) ও ননদ দরিচর গ্রামের জব্বার আলীর মেয়ে জেসমিন আক্তার (১৮) এবং রংপুরের সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তছিরন বেগম (৫৫)। গত রাত সোয়া ১১টার দিকে তছিরন বেগমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। একই হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন দগ্ধ মিনারা বেগম (২০)। আর পুড়ে যাওয়ার কারণে শিশুটিকে কেউ চিনতে পারছে না। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রংপুরের পুলিশ সূত্র জানায়, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা ঢাকাগামী ৩০টি যাত্রীবাহী বাস রংপুর শহরের মডার্ন মোড় থেকে পুলিশ ও বিজিবির পাহারায় রাত সোয়া ১২টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ওই বাস বহরের সামনে পুলিশের গাড়ি ছিল। পেছনে ছিল বিজিবির গাড়ি। বহরের ২৩ নম্বরে ছিল হামলার শিকার খলিল এন্টারপ্রাইজের বাসটি। উলিপুর থেকে ৪০ জনের মতো যাত্রী নিয়ে এটি ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। ১৫ মিনিটের মধ্যে বাসগুলো মিঠাপুকুর উপজেলার জায়গীরহাট পার হয়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বাতাসন ফতেপুর এলাকায় পৌঁছালে হামলার ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক আবদুল কাদের খান জানান, গুরুতর অগ্নিদগ্ধ উলিপুরের কাশিমবাজার গ্রামের জসিম উদ্দিনের মেয়ে তছিরন খাতুন ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার মিনারা বেগমকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া সাতজনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও তিনজনকে রংপুর সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে। চারটি লাশ মেডিকেল কলেজের মর্গে রয়েছে।
নিহত রহিম বাদশার স্ত্রী নিলুফার বেগম (৩২) গতকাল বিকেলে রংপুর মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে জানান, তিনি স্বামী, শাশুড়িসহ পরিবারের তিনজনকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য রাত নয়টার দিকে ওই বাসটিতে তুলে দেন। রহিম ঢাকায় বাদাম বিক্রি করতেন বলে জানান তিনি। বেঁচে যাওয়া আরেক যাত্রী ঢাকার গাজীপুরের ভাওয়াল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আফসানা মিমি। তিনি জানান, তিনিসহ পরিবারের ১১ জন ওই বাসে ছিলেন। হঠাৎ করেই বাসের সামনের অংশে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠতে দেখে সবাই জানালা দিয়ে নামতে থাকেন। বয়স বেশি হওয়ায় তাঁর দাদি নামতে পারেননি। গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হয়ে তিনি এখন চিকিৎসাধীন। আরেক যাত্রী আলেয়া বেগম বলেন, ‘ওই সময় ঘুম ঘুম ভাব ছিল। হঠাৎ চিৎকার শুনি। চোখ মেলিয়া দেখি বাসোত আগুন। জানালা খুলিয়া ঝাঁপ দেই। পুরা বাসটা আগুনে পোড়া গেল।’
প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকারীরা জানান, নিহত ব্যক্তিদের শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। মরদেহগুলো শনাক্ত পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। তবে একজনের হাতের চুড়ি দেখে ও আরেকজনের চুল দেখে শনাক্ত করা হয় যে তাঁরা নারী। ঘটনাস্থলের পাশে বাড়ি মকবুল হোসেনের (৬৮)। ঘটনার পর মানুষের আর্তচিৎকারে তিনি ঘরের বাইরে এসে আঙিনা থেকে আগুনের কুণ্ডলি দেখেন। তিনিই মিঠাপুকুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনিসকে মুঠোফোনে খবর দেন। তিনি জানান, এ স্থানে আগেও যাত্রীবাহী বাসে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়েছে।
মিঠাপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল আলম জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যেতে যেতেই বাসটির অনেকটাই পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আসার আগেই চারজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। রাতেই ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকা থেকে শিবিরের এক কর্মীসহ নয়জনকে আটক করা হয়। এঁদের মধ্যে একজন অন্য মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আছেন।
রংপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশি পাহারায় ৩০টি যাত্রীবাহী বাস মডার্ন মোড় থেকে একসঙ্গে ছাড়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারা থাকলেও গতির কারণে বাসগুলো কিছুটা ছাড়াছাড়ি হয়ে পড়ে। এই ফাঁকেই নাশকতা ঘটানো হয়েছে। বহরের অন্য বাসগুলো ঢাকার দিকে চলে যায় বলে জানান তিনি। এসপি আবদুর রাজ্জাক গত রাতে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমরা মোটামুটি বুঝেছি, হরতাল দিয়ে যারা নাশকতা করছে, তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে তদন্তে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।’
রংপুরের জেলা প্রশাসক ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘এ ধরনের নৃশংস ঘটনায় আমরা শোকাহত। জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।’
রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত আহত ব্যক্তিদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মহাসড়কের মিঠাপুকুরের সীমান্ত এলাকা থেকে পলাশবাড়ীর সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত একাধিক স্পর্শকাতর স্থানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.