স্বর্গদ্বীপ

স্বর্গদ্বীপে ওলটপালট করে রাখা গাছের গুঁড়িগুলো জানান দিচ্ছে এটা দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। নানা দুর্যোগে এভাবেই এ এলাকার চেহারা বদলে যায়। আবার একখণ্ড বিষমুক্ত সবজির বাগান বার্তা দিচ্ছে মাটিকে ভালবাসো, মাটি তোমাকে আরও বেশি ভালবাসা দেবে! ইটভাটার আঁকাবাঁকা পরিত্যক্ত ফেলনা ইটগুলো এখানে বিমূর্ত রূপে স্থান  পেয়েছে। এই বিমূর্ত প্রতীকী শিল্পকর্ম নীরবে শুধু বলছে সমাজের কেউ ফেলনা নয়, কাউকে অবহেলা করা উচিত নয়। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার তক্তাবুনিয়া বাজারের পাশে গড়ে ওঠা ‘স্বর্গদ্বীপ’-এর খণ্ড দৃশ্যগুলো এমনই। দ্বীপের ঐতিহ্য রক্ষায় এখানে নেয়া হয়েছে এক ভিন্ন উদ্যোগ। স্বর্গদ্বীপটি গড়ে উঠেছে চারুকলা থেকে বের হওয়া চিত্রশিল্পী শাহ আলমের প্রচেষ্টায়। দীর্ঘদিন শহরে বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত থাকলেও স্বর্গদ্বীপের এই ধারণা নিয়ে ফিরেছেন গ্রামে। চিত্রশিল্পী শাহ আলম এই স্বর্গদ্বীপ গড়ে  তোলার কাজ শুরু করেন ২০০০ সালে। চারুকলায় লেখাপড়া শেষ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেছেন বেশ কয়েক বছর। তার মনে হয়েছে শেকড়ের কাছেই সকল প্রশান্তি। তাই ছুটেছেন মাটির কাছে। কৃষক বাবা  কোন্দার আলী হাওলাদারের সঙ্গে শৈশবে কৃষিক্ষেত্রে গিয়ে তার উপলব্ধি হয়েছে, মাটির কাছেই স্বর্গের সুখ। সে কারণেই এই উদ্যোগের পেছনে ছুটছেন তিনি। মাটিকে ভালবাসার বার্তাটি এই দ্বীপের সবার কাছে পৌঁছে দেয়াই আলমের আগামীর স্বপ্ন। আর সে কারণেই নিজে দৃষ্টান্ত হিসেবে বিষমুক্ত ফসল আবাদ করেন। নিজের প্রয়োজনটুকু নিজের জমি  থেকে উৎপাদন করেন। তার ভাষায়, মাটি ন্যায্যটাই আমাদের দেয়, এখানে কোন ঘুষ-দুর্নীতি নেই। আর তার দেয়া বার্তা  পেয়ে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে এলাকার মানুষ। ক্রমান্বয়ে আসছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দ্বীপের গাছপালা, তরুলতা, পশুপাখি, ফসলসহ বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত জীবনধারণের উপকরণ এখানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিষমুক্ত ফসল-সবজি উৎপাদনের এক অভিনব ‘কারখানা’ এটি। মাত্র ৩৫ শতাংশ জমির ওপর গড়ে ওঠা এই আয়োজনটি দেখলে যে কারও মনে হবে এ যেন দ্বীপের মাঝে একখণ্ড স্বর্গ। কী  নেই এখানে! ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত প্রচারের মাইক, ধানভানার ঢেঁকি, মাছধরার ঝাকিজাল, হালচাষের লাঙ্গল-জোয়াল, পরিত্যক্ত কিংবা ব্যবহার হওয়া নানা উপকরণ। এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে মাইক,  টেলিভিশন, পুরনো দিনের হ্যাজাক লাইট, হারিকেনসহ কুপি বাতিও। দুর্যোগের সময় মাইকে পূর্বাভাসসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয়  তথ্যও প্রচার করা হয়। টেলিভিশন খুলে দেয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য। প্রামীণ সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা এই স্বর্গদ্বীপ দিনে ঢেকে থাকে গাছের ছায়ায়, আর রাতে সৌরবিদ্যুতের আলোতে জ্বলে ওঠে  গোটা স্বর্গদ্বীপ। স্বর্গদ্বীপের আছে কয়েকটি ছোট ঘর। এলাকার প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত ঘরগুলো ঠিক এরকমই। চাঁদনি রাতে মুক্ত বাতাসে ঘরের বেড়া আর চালা নড়াচড়া করে বিপন্ন সময়ের কথাই মনে করিয়ে দেয় এগুলো। আবার এসব ঘর দিয়ে বোঝানো হয়েছে, এই দ্বীপে অট্টালিকার প্রয়োজন নেই। কেবল প্রয়োজন নিরাপদে বসবাসের পরিবেশ। ঘরের পাশে ঝোপঝাড়, রাতে ঝিঁঝি  পোকার ডাক, পাখিদের কল-কাকলি, সবই যেন দ্বীপের ঐতিহ্যকেই ধারণ করছে। জৈব সারের মাধ্যমে দেশী জাতের ফসল আবাদের বার্তা সব মানুষের কাছে  পৌঁছে দেয়া আলমের অন্যতম লক্ষ্য। এই পদ্ধতিতে নিজের জমিতে যেমন চাষাবাদ করছেন, তেমনি অন্য চাষিদের পাশে  থেকে দিচ্ছেন নানা পরামর্শ। শাহ আলম বলেন, ‘কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া ধানের স্থানীয় জাতগুলো এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এরমধ্যে লক্ষ্মীবিলাস, কালিজিরা, দুধকলম, কালাকোরা, সাদামোটা, আরমান মোটা, ফুলমতি উল্লেখযোগ্য। প্রায় ৪০ জাতের ধান সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে জানালেন তিনি।’ দ্বীপে নেই এমন পশুপাখি এখানে নিয়ে আসার উদ্যোগও রয়েছে স্বর্গদ্বীপের। বিভিন্ন স্থান থেকে এগুলো সংগ্রহ করে এখানে আনার পর তা লালন পালন করে বনে ছেড়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন সময় বানর, কাঁঠবিড়ালী, খরগোশ, শূকর, অস্ট্রেলিয়ান গাভী এই দ্বীপে এসেছে স্বর্গদ্বীপের মাধ্যমে। এখানে এখনও সংরক্ষিত আছে বক, তিত মোরগ, দেশী হাঁস, রাজহাঁস, ডাহুকসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। জীবন্ত প্রাণীর সঙ্গে স্বর্গদ্বীপের কোথাও আবার শিল্পীর তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে বিভিন্ন পশুপাখি। আবার কোথাও পাখি কিংবা পশুর মুখের আকৃতি দেয়া হয়েছে  ফেলনা কাঠ দিয়ে। স্বর্গদ্বীপের ব্যাপারে বড়বাইশদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু হাসনাত আব্দুল্লাহ জানান, ‘স্বর্গদ্বীপ গড়ে তোলার পেছনে একমাত্র শাহ আলমের অবদান রয়েছে। কেবল তার প্রচেষ্টায় এই স্বর্গদ্বীপ।’

No comments

Powered by Blogger.