লাল মখমল দোলনার মেয়ে

সেকালের দুনিয়া ইভলিন নেস্টবিটকে ডাকত ‘আমেরিকান ইভ’। শত বছর আগেই মডেল হিসেবে খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেছিলেন তিনি। বলা হয়, ইভলিনই আধুনিক বিশ্বের প্রথম নারী সুপার মডেল। এই সুন্দরীকে ঘিরে ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্বে ঘটেছে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। সেই হত্যার বিচার ঘিরে আদালত বিব্রত হয়েছে, সমাজ বিভক্ত হয়ে গেছে। সেই প্রেমকাহিনি লোকগল্প হয়ে ছড়িয়ে গেছে নাট্যমঞ্চে, গল্পে, কবিতায়, চলচ্চিত্রে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম তাঁরই প্রেমকাহিনি থেকে তাঁকে নাম দিয়েছে ‘লাল মখমল দোলানার মেয়ে’। বিবিসি অবলম্বনে এই প্রতিবেদনে জানুন বিশ্বের প্রথম নারী সুপার মডেল ইভলিন নেস্টবিটের কথা। সুন্দরের প্রতিমা হয়ে তিনি সবার হৃদয় জয় করেছেন। শিল্পীরা তাঁর ছবি এঁকেছেন। আলোকচিত্রীরা তাঁর ছবি তুলেছেন। ফ্যাশন ডিজাইনাররা তাঁকে মডেল বানিয়েছেন। তামাটে চুলের কিশোরী ইভলিন নেস্টবিটের গ্ল্যামার জগতে পা রাখার কাহিনি অনেকটা ধ্রুপদি গল্পের মতোই। ফিলাডেলফিয়ার এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইভলিন। কিন্তু অর্থনৈতিক রূপান্তরের টালমাটাল সময়ে ঋণের বোঝা রেখে আকস্মিকভাবে মারা যান ইভলিনের বাবা। সংসার সামলাতে হিমশিম খাওয়া মায়ের পাশে দাঁড়াতে কিশোরী বয়সেই ইভলিনকেও রোজগারের পথে পা বাড়াতে হয়।
(ছবি:১ পোশাক যা-ই হোক ইভলিনের মধ্যে যেন সব সময়ই প্রতিমার মতো সৌন্দর্যের সঙ্গে এক প্রচ্ছন্ন যৌন আবেদন মিলেমিশে থাকত। ছবি: উইকিপিডিয়া ছবি:২ ইভলিন নেস্টবিট। জন্ম: ২৫ ডিসেম্বর ১৮৮৪। মৃত্যু: ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৭। ছবি: উইকিপিডিয়া ছবি:৩ বনপরী, জিপসি নারী, জাপানি গেইশা থেকে শুরু করে গ্রিক দেবী পর্যন্ত বহু চরিত্রেরই মডেল হয়েছেন ইভলিন নেস্টবিট। ছবি: উইকিপিডিয়া)
ইভলিন এমন এক সময় বেড়ে ওঠেন যখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রূপান্তরের কাল। অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আমেরিকার বেড়ে ওঠার সোনালি যুগ সেটা। কিন্তু একই সঙ্গে ইউরোপ থেকে বিপুল সংখ্যায় অভিবাসী আসা এবং দারিদ্র্য বিস্তারেরও সময় সেটা। অভিজাত পরিবারে জন্ম নেওয়া এবং অকালে পিতৃহীন হওয়ায় অল্প বয়সেই জীবনের দুই দিকই দেখতে হয়েছিল ইভলিনকে। ইভলিন প্রথমে কাজ শুরু করেন উদীয়মান শিল্পীদের ছবি আঁকার মডেল হিসেবে। তবে ভদ্রঘরের মেয়ে ইভলিনকে শিল্পীদের জন্য নগ্ন হয়ে মডেল দিতে হয়নি। তাঁর জীবনীকারের ভাষায় ‘এর পরও অসম্ভব সুন্দর মুখশ্রীর ইভলিনের কদর ছিল অনেক।’
১৯০০ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে নিউইয়র্কে চলে আসেন ইভলিন। নতুন শতাব্দীর শুরুতে ইভলিনের নতুন যাত্রা কেবল তাঁর জীবনকেই পাল্টে দেয়নি, বরং শিল্পাঙ্গনসহ বিকাশমান গ্ল্যামার জগতকেও পাল্টে দিয়েছিল। নিউইয়র্কে নিজেকে মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠায় ইভলিনকে সহায়তা করেছিলেন তাঁর শুরুর দিককার পথপ্রদর্শক-পৃষ্ঠপোষক জেমস ক্যারল বেকউইথ। এ সময় খ্যাতনামা বহু শিল্পীর মডেল হয়েছেন তিনি। এখন নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের সংগ্রহে থাকা ‘ইনোসেন্স’ নামে ভাস্কর জর্জ গ্রে বার্নার্ডের বিখ্যাত ভাস্কর্যের মডেলও তিনি। চার্লস ডানা গিবসনের ‘উইমেন: দ্য ইটারনাল কোয়েশ্চন’ ছবিটির মডেলও তিনি। শিল্পীদের ছবি, ভাস্কর্য থেকে শুরু করে সাময়িকীর প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ আর অগণিত বিজ্ঞাপনে ছাপা হতে থাকে ইভলিনের মুখ। সে সময়কার বিখ্যাত সাময়িকী ভ্যানিটি ফেয়ার, হার্পার্স বাজারের একাধিক প্রচ্ছদের মডেল হয়েছেন তিনি। টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে মুখের ক্রিমের বহু বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন ইভলিন।
বনপরী, জিপসি নারী, জাপানি গেইশা থেকে শুরু করে গ্রিক দেবী পর্যন্ত বহু চরিত্রেরই মডেল হয়েছেন এই সুন্দরী তরুণী। গ্ল্যামার মডেল হিসেবেও সব সময় শালীন পোশাকেই দর্শকের সামনে হাজির হতেন ইভলিন। কিন্তু পোশাক যা-ই হোক, ইভলিনের মধ্যে যেন সব সময়ই প্রতিমার মতো সৌন্দর্যের সঙ্গে এক প্রচ্ছন্ন যৌন আবেদন মিলেমিশে থাকত। ইভলিনের রূপের এই প্রচ্ছন্ন আবেদনময়তাই হয়তো সেকালে ইভলিনের তুমুল জনপ্রিয়তার অন্যতম বড় কারণ। নতুন মাধ্যম হিসেবে ফ্যাশন ফটোগ্রাফির বিকাশের এই সময়েই দুনিয়াজুড়ে সুপার মডেলের খ্যাতি অর্জন করেন ইভলিন। আঁকা ছবির অলঙ্করণের জায়গায় আলোকচিত্রের স্থান করে নেওয়ার সে সময়টায় দ্রুত মানুষের চোখে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। এ এমন এক সময় যখন তাঁর ছবি ছাপা হলে পত্রিকার বিক্রি বেড়ে যায়। নগরের পানশালা আর অভিজাতদের আড্ডায় একই সময়ে যুবা-পুরুষরা মদিরা হাতে পানপাত্র ঠোকে ইভলিনের নামে। শিগগিরই নিউইয়র্কের ব্রডওয়ে থিয়েটার বা মঞ্চনাটকে স্থান করে নেন ইভলিন। বুনো গোলাপ নামের একটা নাটকে প্রথম স্বতন্ত্র চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এ সময়ই পত্র-পত্রিকার মুখরোচক কলামগুলোতে ইভলিনের নামে নানা কিসসা-কাহিনি ছাপা হতে শুরু করে। সাফল্যের শিখরে থাকার সময়ই করুণ পরিণতির প্রেমকাহিনি আরও আলোচিত-সমালোচিত করে তোলে ইভলিন নেস্টবিটকে। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন, ওয়াশিংটন স্কয়ার আর্চসহ বহু বিখ্যাত স্থাপনার স্থপতি স্ট্যানফোর্ড হোয়াইটের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ইভলিন। সুন্দরী মডেল ইভলিনের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকা ধনী স্থপতি স্ট্যানফোর্ড প্রেমের স্বীকৃতি হিসেবে প্রেমিকাকে একটা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট উপহার দেন। কিন্তু বছর না গড়াতেই বিচ্ছেদ ঘটে দুজনের। শিগগিরই কয়লা ও রেল ব্যবসায়ী ধনকুবের হ্যারি কে থ-কে বিয়ে করেন ইভলিন। সাবেক প্রেমিক আর বর্তমান স্বামী বিবাদে জড়িয়ে পড়েন ইভলিনকে নিয়ে। এক সন্ধ্যায় ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এক অনুষ্ঠান চলাকালে উত্তেজিত হয়ে স্থপতি স্ট্যানফোর্ডকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন ধনকুবের হ্যারি। এই হত্যাকাণ্ডে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় পুরো আমেরিকায়। আদালতে বিচার চলাকালে প্রত্যক্ষদর্শী এবং গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে ইভলিনের বক্তব্য শুনতে উদগ্রীব হয়ে থাকে সবাই। আদালতে নিজের প্রেম এবং দাম্পত্য নিয়ে ইভলিন যে বিশদ সাক্ষ্য দেন, ছাপার হরফে সেসব পড়তে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জনগণ। পত্রিকার কাটতি বাড়তে থাকে। রক্ষণশীল খ্রিষ্টানরা আদালতকে অনুরোধ করে এই সাক্ষ্য পত্রিকায় ছাপা বন্ধ করতে। বিচারকেরা বিব্রত হয়ে পড়েন। এমনকি আদালতে অভিযোগ ওঠে যে, ইভলিনের মা তাঁর মেয়েকে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করেছেন। মামলার রায়ে ইভলিনের স্বামী ধনকুবের হ্যারির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এবং একটা হাসপাতালে অন্তরীণ অবস্থাতেই মারা যান তিনি। সংবাদমাধ্যমসহ জনগণের ব্যাপক আগ্রহ এবং নাটকীয় হত্যাকাণ্ডের নাটকীয় বিচারকাজের জন্য এই বিচারকে আমেরিকার ইতিহাসে শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত বিচারকাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আদালতে নিজের জবানিতে প্রেমিকের উপহার দেওয়া একটা ‘লাল মখমলের দোলনা’ নিয়ে ইভলিনের প্রেমকাহিনি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে ইভলিন পরিচিতি পান ‘লাল মখমল দোলনার মেয়ে’ হিসেবে। পরে ইভলিনের জীবদ্দশাতেই ১৯৫৫ সালে লাল মখমল দোলনার মেয়ে নামে একটা সিনেমাও মুক্তি পায় হলিউড থেকে। ইভলিন নিজে সেই সিনেমার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তামাটে চুলের এক কিশোরীর মডেল হয়ে ওঠা, তাঁর জীবনসংগ্রাম এবং ট্র্যাজিক প্রেমকাহিনি নিয়ে সে সময় থেকেই অনেক গল্প-কবিতা-নাটক রচিত হয়েছে। এমনকি ২০১০ সালেও এইচবিও টিভি সিরিজ ব্রডওয়াক এমপায়ারের গিলিয়ান চরিত্রটিও ইভলিনের ছায়া অবলম্বনেই রচিত। উনিশ শতক থেকে বিশ শতকে রূপান্তরের পর্বে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের টালমাটাল সময়ের ছবিতে চিরদিনের জন্যই রয়ে যাবে ইভলিন নেস্টবিটের নাম। প্রথম যুগের সুপার মডেল হিসেবে ইভলিন যে পথে হেঁটেছিলেন, তা পেরিয়ে যাওয়া হয়তো তাঁর উত্তরসূরি আজকের অনেক সুপার মডেলের পক্ষেও সম্ভব না। ইভলিনের জীবনীকার পাওলা উরুবুরু যেমন মন্তব্য করেছেন—‘করুণ হলেও সত্য যে, তারকা হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকার প্রথম সুপারমডেল, যৌনতার দেবী এবং সুবিধাভোগী এই সেলিব্রেটি সে সংস্কৃতিরই শিকার হয়েছেন, যে সংস্কৃতি নিজেই তাঁকে তৈরি করেছে এবং তাঁকে ভোগ করেছে।’

No comments

Powered by Blogger.