মেয়াদোত্তীর্ণ অটোরিকশা- পকেট কাটা হচ্ছে যাত্রীদের by আনোয়ার হোসেন

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলরত প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশাই এখন কার্যত অবৈধ। কারণ, গত ৩১ ডিসেম্বর এগুলোর বর্ধিত মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এ অবৈধ অটোরিকশার সংখ্যা দুই মহানগরে চলাচলকারী মোট অটোরিকশার ৭৪ শতাংশ। অটোরিকশার ভাড়া ও মালিকের জমা নির্ধারণ করা হয় এর বয়সসীমার ওপর। শুরুতে অটোরিকশার বয়সসীমা নির্ধারিত ছিল নয় বছর। সেই অনুসারেই এর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল। ঢাকা জেলা অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির চাপে ২০১০ সালে মেয়াদ বৃদ্ধি করে ১১ বছর করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ আবার চার বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ালে হাইকোর্ট তা স্থগিত করেন। এসব অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল ২০০১ ও ২০০২ সালে। নিয়মানুযায়ী, অটোরিকশার মেয়াদ শেষ হলে তার চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে। তবে সরকার এর মেয়াদ বৃদ্ধি করলে ভাড়া ও জমা কমানো হবে। কিন্তু দুই মহানগরের কোথাও ভাড়া কমানো হয়নি। সেই সুবিধা ভোগ করে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এই বিপুলসংখ্যক অটোরিকশা আগের মতোই যাত্রীদের পকেট কাটছে। এখন মেয়াদোত্তীর্ণ অটোরিকশার বয়স বৃদ্ধি করা হবে, নাকি এর স্থলে নতুন অটোরিকশা বরাদ্দ দেওয়া হবে—এই নিয়ে দর-কষাকষি চলছে।
২০০১ সালে চালুর পর থেকেই অটোরিকশার চালক-মালিকেরা সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া ভাড়া মানেননি। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও এটা মানানোর কোনো চেষ্টা করেনি। ফলে বছরের পর বছর ধরে দেশের প্রধান দুই শহরের যাত্রীরা অটোরিকশার চালকদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। রাস্তায় বের হয়ে যানবাহনসংকটে নাকাল যাত্রীরা মিটারের বদলে কয়েক গুণ বেশি ভাড়ায় চুক্তিতে যেতে বাধ্য হচ্ছে। মালিক ও আমদানিকারকদের সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাজারে একটি নতুন অটোরিকশার দাম চার লাখ টাকা। কিন্তু ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকায় কেনা মেয়াদোত্তীর্ণ অটোরিকশার মালিকানা হাতবদল হচ্ছে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায়। এর মূল কারণ, ২০০৩ সাল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অটোরিকশার নতুন নিবন্ধন বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ফলে যে অটোরিকশাগুলো রাস্তায় আছে, সেগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করছে। আর এ গাড়িগুলো পুরোনো হলেও বিক্রি হচ্ছে অনেক বেশি দামে। অটোরিকশার খাতের রমরমা মুনাফার একটা হিসাব দিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি নামে একটি সংগঠন। তাদের হিসাবে, ২০০১ সালে ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকায় কেনা একটি অটোরিকশা দিয়ে ১১ বছরে চালক-মালিকেরা ৯২ লাখ টাকা আয় করেছেন। একাধিক অটোরিকশার মালিক এ প্রতিবেদককে জানান, ঢাকায় কারও দুটি অটোরিকশা থাকলে তাঁর অন্য কোনো কাজ করার দরকার হয় না। তবে ঢাকা অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ বলেন, ‘শুধু আয় দেখলে হবে না, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও অনেক।’
অটোরিকশা খাতে নৈরাজ্যের বিষয়ে বরকত উল্লাহ বলেন, ‘এটা সত্য, আমরা সেবা দিতে পারিনি। আমাকেই রাজধানীর কমলাপুর থেকে এলেনবাড়ি যেতে ২০০ টাকা গুনতে হয়। এই পথে মিটারে গেলে ভাড়া আসে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। অটোরিকশার স্বল্পতা ও চালকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই এমন হয়েছে।’ অবশ্য ঢাকা জেলা অটোরিকশা চালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন দাবি করেন, মালিকেরা বাড়তি জমা চাপিয়ে দেন বলেই যাত্রীদের কাছ থেকে তা তুলতে হচ্ছে চালকদের। তিনি বলেন, অটোরিকশার তুলনায় চালক বেশি বলে মালিকেরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে পড়েছেন। বিআরটিএর হিসাবে, ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা রয়েছে ১২ হাজার ৭১৫টি। চট্টগ্রামেও প্রায় ১৩ হাজার। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় সাড়ে ১১ হাজার এবং চট্টগ্রামে আট হাজার অটোরিকশার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। মেরামত নাকি প্রতিস্থাপন: বিআরটিএ সূত্র জানায়, ২০১০ সালে মালিক সমিতির চাপে সরকার নতি স্বীকার করার ফলে আবার মেয়াদ বৃদ্ধির আন্দোলন শুরু করে তারা। একাধিক বৈঠক করার পর গত ৪ জুন ছয় শর্তে মেয়াদোত্তীর্ণ অটোরিকশার মেয়াদ আরও চার বছর বাড়িয়ে ১৫ বছর করার সিদ্ধান্ত দেয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। ছয় শর্তের মধ্যে রয়েছে ইঞ্জিন ওভারহলিং করা, হুড-বডি পরিবর্তন করে নতুন রং করা, সিএনজি সিলিন্ডার পরীক্ষা করা এবং অন্যান্য মেরামত করা। এসব করে বুয়েট ও চুয়েট থেকে ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মালিকদের অনেকে এই প্রক্রিয়ায় যেতে আগ্রহ দেখাননি। কারণ, এই শর্ত পূরণ করতে হলে প্রতিটি অটোরিকশার পেছনে প্রায় এক লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে। এ ছাড়া যথাযথভাবে শর্ত পূরণ হয়েছে কি না, তা দেখে ছাড়পত্র দেওয়ার যে সক্ষমতা বুয়েটের রয়েছে, তাতে এক বছরে বড়জোর তিন হাজার অটোরিকশা ছাড় পাবে। এ অবস্থায় ১৭৫ জন সাধারণ মালিক ঝক্কিতে না গিয়ে পুরোনো অটোরিকশা ঢাকার বাইরে বিক্রি করে দিয়ে এর স্থলে নতুন অটোরিকশা নামানোর অনুমতি চেয়ে বিআরটিএতে আবেদন করেন। এগুলো যাচাই-বাছাই করার জন্য বিআরটিএর সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটিও হয়েছে। কমিটি পরীক্ষা করে ৪৫টি অটোরিকশা প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করে। কিন্তু চূড়ান্ত অনুমোদন আর দেয়নি সংস্থাটি। এরপর ১৭ জন মালিক বিআরটিএর চেয়ারম্যানসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উকিল নোটিশও দিয়েছেন।
এ অবস্থায় সাধারণ মালিকদের একটা অংশ মেয়াদ বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে নীতিমালাবহির্ভূত দাবি করে হাইকোর্টে রিট করে। আদালত গত মাসে মেয়াদ বৃদ্ধির কার্যক্রমের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেন। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের রায়, মালিকদের দাবি আর অটোরিকশার স্বল্পতা—সব মিলিয়ে জটিল অবস্থা চলছে। তবে খুব শিগগির সমাধান হয়ে যাবে। সরকার শুধু চালক-মালিকদের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত—এমন অভিযোগের বিষয়ে সচিব বলেন, ‘এটা ঠিক নয়। ভাড়া ও জমা অমান্য করার দায়ে অনেককে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.