বছরজুড়ে শিরোনামে ছাত্রলীগ

বছরজুড়েই নেতিবাচক শিরোনামে ছাত্রলীগ। নানা বিতর্কিত কর্মকা-ে জড়িয়ে সংগঠনটি ছিল আলোচনার শীর্ষে। অপরাধমূলক কাজে ভাড়ায় খাটা, মাদক ব্যবসা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, ভর্তি-বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ নিজেদের মধ্যে খুনখারাবি ও প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা। তবে সারা বছরের উত্তাপে আরেকটু আগুন লাগিয়েছে সম্প্রতি শাহজালাল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি-স্টাইল বন্দুকযুদ্ধে নিজেদের দু’জন কর্মীকে হত্যা এবং গত সপ্তাহে রাজধানীর বকশীবাজারে ছাত্রদলের ওপর হামলার ঘটনা। এভাবেই বছর শেষ করেছে ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনটি। বছরের শেষ দিকে নভেম্বর মাসে সারা দেশে ‘ক্লিন ক্যাম্পাস সেভ ক্যাম্পাস’ নামে একটি কর্মসূচি দিয়ে সংগঠনটির মধ্যে ইমেজ ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এ কর্মসূচির নামে চলেছে ব্যাপক চাঁদাবাজি, যা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
বছরজুড়েই খুনখারাবি: গত এক বছরে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে ৫ শতাধিক সংঘর্ষ ঘটিয়েছে। এ সব ঘটনার নেপথ্যের কারণ ছিল আধিপত্য বিস্তার ও পদপদবির লড়াই। অথচ গত ৫ই জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগের অবস্থা এমনটি ছিল না। অনেক নেতাকর্মী কমিটিতেই আসতে চাইতেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭১ সদস্যের হল কমিটি করার টার্গেট ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ হলে কমিটি দেয়নি। যেগুলোতে হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। নির্বাচনের আগে দলীয় মিছিলে গড়ে ১৫-২০ জনের মতো উপস্থিতি ছিল। অথচ এখন সেখানে গণজোয়ার! ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সর্বশেষ নিহত হয়েছেন তাপস পাল। গত ১৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সহযোদ্ধার গুলিতে খুন হন। এর আগে ২০শে নভেম্বর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ছাত্রলীগের কর্মী ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সুমন দাস নিহত হন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন। ওই দিন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে গত এক বছরে এ নিয়ে চারবার এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলো। চলতি বছরের প্রথম খুনের ঘটনা ঘটে গত ৩১শে মার্চ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি)। আশরাফুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী সায়াদ ইবনে মমতাজ নিহত হন এদিন। ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে তাকে খুন করা হয়। ৪ঠা এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ নিজ কক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি সংগঠনের পরবর্তী সম্মেলনে ওই হল শাখার সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, পদ নিয়ে সৃষ্ট অন্তর্দ্বন্দ্বেই প্রাণ হারাতে হয়েছে তাকে। ১৪ই জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাঈমুল ইসলাম রিয়াদকে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ৩১শে আগস্ট ঢাকায় সমাবেশ শেষ করে ফেরার পথে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা তৌকির ইসলামকে। বিগত ছয় বছরে ছাত্রলীগের এ ধরনের ঘটনায় মোট ৪০ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া সম্প্রতি ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলের কারণে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাতের শঙ্কা প্রকাশ করে প্রতিবেদন দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সুযোগে ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ অন্যান্য বিরোধী ছাত্র সংগঠন ও স্বার্থান্বেষী মহল অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরকারের ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি জানাতে চিঠি দিয়েছে।
খুনোখুনির নেপথ্যে: বছরজুড়ে বেপরোয়া তৃণমূল ছাত্রলীগের লাগাম ধরতে পারেনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ। হত্যা, চুরি, ছিনতাই, জমি দখল, ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণসহ সব ধরনের অপরাধেই জড়িয়ে পড়েছে তারা। এর কারণ হিসেবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চিহ্নিত করেছে দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনের কাউন্সিল না হওয়া। এর ফলে ভেঙে পড়েছে দলীয় শৃঙ্খলা। ফলে ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। বর্তমান কমিটি ২০১১ সালের ১১ই জুলাই দায়িত্ব গ্রহণ করে। গত বছরের ১১ই জুলাই শেষ হলেও নতুন কমিটি দেয়ার কোন উদ্যোগ নেই। ফলে যে যার মতো করে অপকর্ম করে যাচ্ছে। তাদের সামাল দিতে না পেরে বহিষ্কারের নামে একটি নাটক করেছে বছরজুড়ে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এর নেপথ্যের কারণ বলেছে, কেন্দ্রীয়সহ বেশির ভাগ মহানগর, জেলা নেতারা সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত না থেকে আখের গোছানোর কাজেই বেশি সময় দিচ্ছেন। এ কারণে কোথাও বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আধিপত্য বজায় রাখতে বিপরীত দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার পাশাপাশি নিজ দলের কর্মীদেরও খুন করছে ছাত্রলীগ।
প্রশ্নফাঁসে জড়িত ছাত্রলীগ: ছাত্রলীগের অর্থ উপার্জনের ব্যবসায় বিগত বছরে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল ভর্তি জালিয়াতি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন চাকরির পাস করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেয় এক শ্রেণীর নেতাকর্মী। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজধানীর প্রতিটি সরকারি ও বড় বেসরকারি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা এ বাণিজ্যে জড়িত। অনার্সে অনলাইনে ভর্তি করা চালু হওয়ার পর ছাত্রলীগের নতুন করে প্রশ্নফাঁস আর ডিজিটাল জালিয়াতির জোগান দিয়েছে সংগঠনটি। চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল ভর্তি জালিয়াতি ও প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিল সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী। একই অভিযোগে ঢাবি’র ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া প্রশ্নফাঁসের বেশির ভাগ ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় বিশ্ববিদ্যালয় ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ। চলতি মাসে ঢাবি মুহসীন হলে ১২০০ পিস ইয়াবাসহ ধরে পড়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী। এর সঙ্গে ঢাবি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করে আটক কর্মীরা। তবে অদৃশ্য কারণে এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংবাদ সম্মেলন করে খুলনা মহানগরের ছাত্রলীগের একটি অংশ জানায়, সংগঠনের মহানগর ও উপজেলা শাখার শীর্ষ নেতারা মাদক ব্যবসায় জড়িত। জানা গেছে, শুধু খুলনা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের এক শ্রেণীর নেতাকর্মী মাদক ব্যবসায় জড়িত।
অপহরণ: বছরের শুরু থেকে অপহরণের ঘটনার জন্য আলোচিত ছিল ছাত্রলীগ। অন্তত ১৩টি অপহরণের ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ। ১৩ই ফেব্রুয়ারি সূর্যসেন হলে মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের তরিকুল ইসলামকে অপহরণ করে আটকে রাখে আরিফুর রহমান। ২৮শে ফেব্রুয়ারি হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল আলম প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের এক দোকানদারকে ধরে নিয়ে আসে। ৬ই মে ফার্সি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এ বি মাইনুল ইসলামকে চানখাঁরপুল থেকে অপহরণ করে ঢাকা কলেজের বিলুপ্ত কমিটির প্রচার সম্পাদক সোহেল রানা। ৯ই মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চ থেকে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ১৮ই নভেম্বর জগন্নাথ হলে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা উৎপল সাহার ছোট ভাই বহিরাগত উদয় সাহা এক গাড়ির চালককে হলে এনে আটকে রাখে। পরে মারধর করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এসব ঘটনায় ২-৩টা মামলা হলেও পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে নি। আবার ঘটনার সময় যাদের আটক করা হয়েছিল তাদেরও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবির ঘটনা ঘটে অন্তত ছয়টি। গত জুলাই মাসে ঢাকা কলেজেরই ছাত্রলীগ নেতা ইমরান হোসেনকে আটকে রেখে মুক্তি দাবির ঘটনা ঘটিয়েছেন ছাত্রলীগের উপপরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.