মিলান কুন্দেরা ও তার সৃষ্টিবিশ্ব by আহমেদ বাসার

লেখকরা বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়েও পাঠককে বিস্মিত করার মতো লেখা সৃষ্টি করে যেতে পারেন- এ কথা অনায়াসে বলা যায়। এমনকি, তাদের মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। এ ক্ষেত্রে একটি বা দুটি সাধারণ ঘটনা সচরাচর ঘটে থাকে- একটি নির্দিষ্ট সময় পর তারা হতাশ হয়ে পড়েন, কারণ তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে; অথবা তারা উপলব্ধি করতে পারেন যে, একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছেন- নয়তো তারা সর্বজনস্বীকৃত হয়ে ওঠেন। সাময়িকভাবে দুটি ঘটনা একই সঙ্গেও ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে (ফিলিপ রথের কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়) আমরা আমাদের হতাশাকে মেনে নিই এবং শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকি। মিলান কুন্দেরা এ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে একটি বিরল ব্যতিক্রমী উদাহরণ হিসেবে উপস্থিত হন। ভেবে দেখুন যখন আপনি প্রথম দ্য বুক অব লাফার অ্যান্ড ফরগেটিং অথবা দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিং পড়েছেন, তখন এগুলোর বৈচিত্র্যময় গঠনশৈলী, বিষয় ও অভিনব চিন্তা কতটা বিস্মিত করেছিল আপনাকে। এখানে শুধু কৌশলগত নতুনত্বের বিষয় নয়, বরং নতুন জ্ঞানের আধার পুনর্বিন্যস্তকরণের ঔপন্যাসিক ধারণারও বিষয়।
প্রথাগত উপন্যাসচিন্তা থেকে এই গ্রন্থগুলোকে মূল্যায়ন করতে গেলে আমরা কিছুটা বিচলিত হতে পারি- একটি গ্রন্থে দেখা যায়, কামুক ডাক্তার বিনি হিলিসলি নার্সদের বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করছেন। যদিও টেস্টামেন্টস বিট্রেইড-এ কুন্দেরা চরিত্র, গল্প ও পরিবেশকে উপেক্ষা করে উদ্ভাবনী প্রশ্নচিহ্নবোধক ‘নভেলিস্টিক এসে’র দিকে মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। বলা যায়, তিনি ঘটনা বর্ণনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন (মার্টিন আমিজ যেমন এর দ্বারা প্রভাবিত)। কুন্দেরার স্বতন্ত্র ও অগ্রণী এই বর্ণনাভঙ্গি অনেককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। অ্যাডাম থার্লওয়েল তার পলিটিকস গ্রন্থে এবং ক্রেইগ রেইনি তার হার্টব্রেক গ্রন্থে এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন। কুন্দেরা- যিনি চেক প্রজাতন্ত্র থেকে ফ্রান্সে গিয়ে স্থিত হয়েছেন- ইতিমধ্যে তিনটি ছোট উপন্যাস ও একটি উদ্দীপনামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। আঙ্গিকগত দিক থেকে এগুলো খুবই বৈচিত্র্যময়। দ্য কারটেইন এবং এনকাউন্টার পরস্পর সম্পর্কিত রচনা, যেগুলো প্রাচীন বিষয়-আশয় (অস্তিত্ববাদ ও নান্দনিকতা) ও প্রাচীন প্রেমের ওপর চিন্তা এবং স্মৃতিময়তার প্রলেপে রচিত।
প্রাবন্ধিক মায়াজাল সৃষ্টিতে কুন্দেরার দক্ষতা তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল করে তোলে, করে তোলে চির আগ্রহী। এমন অনেক লেখককে তিনি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন যাদের কথা আমাদের জানা ছিল না। তার প্রথম দিকের গ্রন্থগুলো পড়েই এদের (ইয়ানিস জেনাকিস, মারেক বিয়েনজিক, গুবার্গুর বার্গসন) সম্পর্কে জানা যায়। কুন্দেরার মূল বিষয় মূলত ‘দর্পণ’। বিভিন্নভাবে বিকৃত সমাজ ও পরিপার্শ্বের প্রতিফলন তার সাহিত্যকর্মে লক্ষ্যযোগ্য। স্যামুয়েল বেকেট সম্পর্কে ফ্রান্সিস বেকনের একটি উক্তিকে তিনি এ ক্ষেত্রে যুতসইভাবে ব্যবহার করেছেন- যখন একজন শিল্পী অন্য কোনো শিল্পী সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেন, তখন তিনি পরোক্ষভাবে নিজের সম্পর্কেই বলেন। এবং যে বিষয়টি তিনি নিজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, সেই বিষয়েই গুরুত্বারোপ করেন।
অবশ্যম্ভাবীভাবে, তার এই অন্তর্ভেদী পর্যবেক্ষণ- যা অন্যদের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য তার নিজের ক্ষেত্রেও- বহুল পরিচিত। কাফকা আপাতসত্যের সীমাকে অতিক্রম করেছিলেন বলে দ্য কারটেইন-এ তিনি উল্লেখ করেছেন। টেস্টামেন্টস বিট্রেইড কিংবা এনকাউন্টার-এ পৃথিবীর স ষ্টার অসম্ভাবনীয়তাকে যুক্তির দ্বারা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়াও বহু প্রতিষ্ঠিত বিষয়কে তীর্যক ভঙ্গিতে এখানে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
টেস্টামেন্টস বিট্রেইড শুরু হয়েছে র‌্যাবেলিস [ফ্রান্সিস র‌্যাবেলিস (১৪৯৪-১৫৫৩) একজন ফরাসি স্যাটায়ার লেখক। হাস্যরস সৃষ্টির জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি- প্যান্টাগ্রুয়েল (১৫৩২) এবং গার্গেনচুয়া (১৫৩৪)] ও ‘হাস্যরসের উদ্ভব’ প্রসঙ্গ দিয়ে। এই সময়ের মধ্যে কুন্দেরা লক্ষ্য করেছেন, দস্তয়েভস্কির দ্য ইডিয়ট-এর যে চরিত্রটি বেশি হাসাহাসি করে তার আসলে হিউমার সেন্স নেই। এই তীক্ষ্ণ মন্তব্য জেদ স্মিথের হলিউড সম্পর্কিত একটি মন্তব্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়- কৌতুক শুধু হাসিতেই শেষ হয় না, বরং শেষ হয় বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। এটা আকর্ষণীয় এবং মজাদার বিষয়ও বটে। কুন্দেরা যা পনের বছর আগে তার সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে টেস্টামেন্টস বিট্রেইড-এ বলেছিলেন, তা তার সৃষ্টিশীল সমালোচনা এনকাউন্টার এও ফলপ্রসূ হয়েছে। অতীতের সাহিত্য থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক কিংবা দালিলিক কোনো কিছু আত্মীকরণের নেই কুন্দেরার। বরং সমসাময়িক জীবন ও জগতের অতল গভীরতায় তার শেকড় প্রোথিত। অন্যদিকে, কুন্দেরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়ের লেখকদের উত্থান ও পতন সম্পর্কে যেমন সচেতন, তেমনি সচেতন তাদের ভাবাদর্শ ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও। এর মধ্য দিয়েই তিনি নির্মাণ করে নেন তার স্বকীয় সৃষ্টিবিশ্ব।

No comments

Powered by Blogger.