দরজা খুলে দেন সুমনা, খুন করেন নজরুল -নবী হত্যা মামলার জবানবন্দি

‘বাল্যবন্ধু’ নজরুলের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য প্রকাশ পাওয়ার ভয় এবং ‘স্বামী’ নবী হোসেনের কাছ থেকে ভরণপোষণ না পাওয়ার ক্ষোভ থেকেই নবীকে খুন করার পরিকল্পনা করেন সুমনা বেগম। গভীর রাতে সুমনা দরজা খুলে দিলে তাঁর প্রেমিক নজরুল দুই সহযোগীসহ ঘরে ঢোকেন এবং ঘুমন্ত নবীকে গলা কেটে হত্যা করেন। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার পরিবহন ব্যবসায়ী নবী হোসেন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সুমনা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন। তাঁর জবানবন্দিমতে, নবীকে হত্যার পর লাশ কয়েক টুকরা করে বস্তা ও ব্যাগে করে একাধিক স্থানে ফেলে দেওয়া হয়। কিশোরগঞ্জ জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের (২) বিচারক হামিদুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার সুমনার এই জবানবন্দি রেকর্ড করেন। আজ শুক্রবার ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বদরুল আলম তালুকদার জবানবন্দির এই তথ্য জানান।
গত ২৫ ডিসেম্বর পৌর শহরের মালাগুদাম এলাকা থেকে হাত-পা-মাথাবিহীন একটি খণ্ডিত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পরের দিন ভৈরব শহর থেকে রাসেল মিয়া নামে নবীর এক পরিচিত ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে ২৮ ডিসেম্বর ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিজেশ্বর এলাকা থেকে নজরুল ইসলাম (৩৮) ও সুমনা বেগম (৩০) নামে নবীর আরও দুই পূর্বপরিচিত ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দিনই পৌর শহরের চণ্ডীবের দক্ষিণপাড়া মহল্লার শহীদ জিয়া তোরণ এলাকার একটি আস্তাকুঁড় থেকে মাথা উদ্ধার করা হয়। পরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়কসেতু এলাকা থেকে হাত ও পা উদ্ধার করা হয়।
ভৈরব থানার ওসি জানান, গত সোমবার থেকে সুমনা ও নজরুল পাঁচ দিনের রিমান্ডে ছিলেন। রিমান্ডে আনার পর হত্যাকা‌ণ্ডের কথা স্বীকার করায় বৃহস্পতিবার সুমনার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
জবানবন্দিতে সুমনা বলেছেন, তাঁর ও নজরুলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজেশ্বর গ্রামে। নজরুল সুমনার বাল্যবন্ধু। ছোটবেলা থেকেই তাঁদের মধ্যে প্রেম ছিল। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার এক ব্যক্তির সঙ্গে সুমনার বিয়ে হয়। কিন্তু সংসার টেকেনি। তাঁর একটি কন্যাসন্তান আছে।
ওসি জানান, সুমনা তাঁদের কাছে দাবি করেছেন নবী হোসেনের স্ত্রী ও সন্তান থাকার পরও কয়েক বছর আগে তিনি সুমনাকে বিয়ে করেন। চার বছর ধরে ভৈরব পৌর শহরের চণ্ডীবের দক্ষিণপাড়ার রওশনআরা বেগমের বাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকতেন সুমনা। কিছুদিন ধরে নজরুলের সঙ্গে সুমনার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তাঁদের মধ্যে গোপন সম্পর্ক হয়। কৌশলে নজরুল মুঠোফোনে ওই মুহূর্তের ছবি ভিডিও করে রাখেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলে ওই ভিডিও প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দেন নজরুল। এতে সুমনা ভয় পেয়ে যান। এ ছাড়া এক বছর ধরে নবী সুমনাকে ভরণপোষণের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ কারণে নবীর প্রতি সুমনা কিছুটা ক্ষুব্ধও ছিলেন। এ রকম বাস্তবতায় নজরুলকে নিয়ে সুমনা নবীকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২১ ডিসেম্বর রাতে চণ্ডীবের মহল্লার ভাড়া বাসায় নবীকে ডেকে আনেন সুমনা। রাত দুইটার দিকে নজরুল দরজায় কড়া নাড়েন। সুমনা দরজা খুলে দেন। ঘরে ঢুকেই চাপাতি দিয়ে ঘুমন্ত নবীর মাথায় আঘাত করেন নজরুল। এতে অচেতন হয়ে যান নবী। পরে খাট থেকে মেঝেতে শুইয়ে প্রথমে তাঁর গলা কাটা হয়। মাথা বিচ্ছিন্ন করার কাজটি করেন নজরুলের এক সহযোগী। হাত কাটেন আরেক সহযোগী। পা দুটি কাটেন নজরুল নিজেই।
টুকরা টুকরা করার পর দেহটি প্রথমে ঘরের পেছনের মাটিতে চাপা দেওয়া হয়। মাথা ব্যাগে করে নিয়ে ফেলা হয় বাসার কাছেই শহীদ জিয়া তোরণ এলাকার আস্তাকুঁড়ে। বস্তায় কাটা হাত ও পা ভরে সেগুলো ফেলা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়কসেতুর ভৈরব প্রান্তে। ওই রাতেই কাজটি করেন নজরুল ও তাঁর সহযোগীরা। বাড়ির পেছনের জায়গায় চাপা দিয়ে রাখা দেহটি ২৪ ডিসেম্বর রাতে তুলে ফেলা হয় মালগুদাম এলাকায়। এরপর সুমনা বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
সহকারী পুলিশ সুপার (বাজিতপুর সার্কেল) মৃত্যুঞ্জয় দে বলেন, এরই মধ্যে নজরুলের পাঁচ দিনের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। এখনো মুখ খুলছেন না তিনি। আজ (শুক্রবার) আরও সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। আগামী সোমবার আবেদনের শুনানি হবে। সুমনা ও নজরুল বর্তমানে কিশোরগঞ্জ কারাগারে আছেন।

No comments

Powered by Blogger.