বিদ্রোহ-কোন্দলে বিপর্যস্ত ছাত্রদল

গ্রুপিং আর অন্তর্কোন্দলে বিপর্যস্ত ছিল বিএনপির অন্যতম প্রধান সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল। গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনের মতো বছরজুড়ে নিষ্প্রভ ছিল সংগঠনটি। বেরিয়ে আসতে পারেনি ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে। নতুন কমিটি ঘোষণার পরও গতি পায়নি সংগঠনটির কার্যক্রমে। বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া রাজপথের আন্দোলনে বড় কোন কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। এমন কি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেও পারেনি নতুন কমিটির নেতারা। উল্টো নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করে প্রতিদিনই সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। আর এ সব বিদ্রোহে নেপথ্যে ইন্ধন দিয়েছেন দলের খোদ প্রভাবশালী নেতারা। নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাল্টাপাল্টি তালা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেই বছর পার করে দিয়েছে সংগঠনটি। ২০১ সদস্যের কমিটি এখনও পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। এমন কি ঢাকা মহানগরসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কমিটিও দিতে পারেনি তারা। বিএনপির ভ্যানগার্ড খ্যাত এ সংগঠনের কমিটি নিয়ে বিদ্রোহ ও সংঘর্ষের কারণে প্রস্তুতি থেমে আছে অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের পুনর্গঠনের উদ্যোগ। তবে বছরের শেষ দিকে খোদ খালেদা জিয়া ও দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতার হস্তক্ষেপ এবং আশ্বাসে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের কিছুটা অবসান হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে বকশীবাজারে ব্যাপক শোডাউন করে ছাত্রদলের নতুন কমিটি। এ সময় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হলেও এ ঘটনার পর কিছুটা উজ্জীবিত ভাব দেখে নতুন কমিটির নেতাকর্মীদের মধ্যে।  ৫ই জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে বিএনপির অন্যান্য সংগঠনের মতো ব্যর্থ ছিল ছাত্রদল। বছরের শুরুতেই শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত তৈরির করতে সংগঠনগুলো পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির চেয়ারপারসন। সে অনুযায়ী ঢাকা মহানগর বিএনপি, যুবদল স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের সঙ্গে বৈঠক করে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেন তিনি। তবে ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব জেলে থাকায় সংগঠনটির সঙ্গে বসতে বিলম্ব হয়। দীর্ঘ ছয় মাস পর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ছাত্রদলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত আগস্টে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তিনটি ম্যারাথন মতবিনিময় বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। ওই সব বৈঠকে ১২৫ জন ছাত্রনেতার প্রস্তাব, মতামত ও অভিযোগসহ সাংগঠনিক অবস্থান সম্পর্কে তাদের বক্তব্য শোনেন তিনি। ওই সময় নেতাদের তারুণ্যনির্ভর ছাত্রদলের কমিটি দেয়ার কথা জানিয়ে দেন খালেদা জিয়া। সম্ভাব্য বেশ কয়েকজন নেতার বায়োডাটা ও তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে নির্দেশ দেন তিনি। এরপর নড়েচড়ে বসেন ছাত্রদলের বয়স্ক নেতারা। শুরু করেন নানামুখী দৌড়ঝাঁপ ও লবিং-তদবির। দলীয় ফোরামে তারা বয়স্কদের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়ার প্রচারণা শুরু করেন। সেই সঙ্গে তারুণ্যনির্ভর কমিটি দেয়া হলে তারা সংগঠন ধরে রাখতে এবং আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা এমন সংশয় ছড়ান। তারা লবিং-তদবিরের পাশাপাশি শুরু করেছেন নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত চরিত্রহনন করে চলে অপপ্রচার। এরপর প্রায় দুই মাস অদৃশ্য ছকের প্রভাবে আটকে থাকে নতুন কমিটি ঘোষণা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর  গত ১৪ই অক্টোবর রাজীব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১ সদস্য বিশিষ্ট ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন দেন খালেদা জিয়া। তবে নতুন কমিটিতে বাদ পড়েন বেশ কয়েকজন আলোচিত ছাত্রনেতা। পাশাপাশি কাঙিক্ষত পদ না পাওয়ায় অসন্তুষ্ট হন অনেকেই। পরদিন থেকেই নয়াপল্টন ও গুলশান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন পদবঞ্চিত নেতারা। ককটেল বিস্ফোরণ, দলীয় কার্যালয়ে পাল্টাপাল্টি তালা দেয়ার ঘটনাও ঘটে। তাদের বিদ্রোহে একাত্মতা পোষণ করেন নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ বেশ কয়েকজন নেতা। এসময় পদবঞ্চিত নেতারা ছাত্রদলের নতুন কমিটিকে এ্যানি-টুকুর ‘পকেট কমিটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পুনর্গঠনের দাবি জানান। বিদ্রোহের প্রথম চারদিন রাজধানীর কোন প্রভাবশালী নেতা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেননি। বিদ্রোহের পঞ্চম দিন যখন নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে মুখোমুখি অবস্থান নেয় দুই গ্রুপ তখনই টনক নড়ে শীর্ষ নেতাদের। দফায় দফায় বিদ্রোহীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালান বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক ছাত্রনেতা রিজভী আহমেদ, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল ।
কিন্তু রাজধানীর প্রভাবশালী বিএনপির নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট এ সব বিদ্রোহী ছাত্রনেতা তাকে উল্টো ভর্ৎসনা করেন। এরপর আগে থেকেই রণপ্রস্তুতি নিয়ে আসা বিদ্রোহী নেতারা আক্রমণ চালায় দলীয় কার্যালয় ও নতুন কমিটির নেতাদের ওপর। একের পর এক হাতবোমার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে নয়াপল্টন এলাকা। ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তুলকালাম কা- ঘটে নয়াপল্টনে। সংঘর্ষের পর চার ঘণ্টা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ থাকাবস্থায় বিদ্রোহী ৬ নেতাকে ডেকে নিয়ে বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর আন্দোলন স্থগিত করে নয়াপল্টন ত্যাগ করেন বিদ্রোহী নেতারা। রাতে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসকে ডেনে নিয়ে বিদ্রোহ নিরসনের দায়িত্ব দেন খালেদা জিয়া। এরপর বিদ্রোহী নেতাদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করলে তাদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। এরপর ৭ই নভেম্বর সিপাহি বিপ্লব দিবস উপলক্ষে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া এ্যানি-টুকুর গাড়িতে হামলা করেন বিদ্রোহী নেতারা। এ ঘটনায় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি আবু সাঈদ, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন ও বর্তমান কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক গাজী মো. রেজওয়ানুল হক রিয়াজকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া আরও সাতজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। এতে আরও ক্ষুব্ধ হয় বিদ্রোহী নেতারা। টানা কয়েকদিন নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ও বিক্ষোভ মিছিল করে তারা। এক পর্যায়ে নতুন কমিটিতে পদ দেয়া হবে- এমন আশ্বাস পেয়ে বিদ্রোহীদের একটি গ্রুপ খালেদা জিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে দলে ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। অপর গ্রুপটিও নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয়। এরপর তিন ছাত্রদল নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। অভ্যন্তরীণ এই বিদ্রোহের অবসান হলেও এখন পর্যন্ত নতুন কমিটির নেতারা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারেনি। এদিকে গত ২১শে অক্টোবর বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের প্রতিবাদে দায়সারাভাবে সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। এদিকে বছরের শেষ দিকে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা চাঙ্গাভাব দেখা যায়। ছাত্রলীগ খালেদা জিয়ার গাজীপুরের সমাবেশ প্রতিহতের ডাক দিলে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেয় ছাত্রদল। ২২শে ডিসেম্বর নয়াপল্টন কার্যালয়ে প্রথমবারের মতো নতুন কমিটির সব নেতা একসঙ্গে উপস্থিত হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। এসময় ছাত্রলীগ ক্ষমা না চাইলে রাজপথে গণধোলাই দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেন ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান। এরপর ২৪শে ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা দেয়াকে কেন্দ্র করে বকশীবাজারে বড় শোডাউন করে সংগঠনটি। এতে নতুন কমিটির নেতাদের সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রুপের নেতারা যোগ দেন। যদিও ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক ছাত্রদল নেতা। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছর পর রাজপথে আন্দোলনে নামায় আশার সঞ্চার হয়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের। প্রতিশোধ নেয়ার মনোভাবও লক্ষ্য করা গেছে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে। নতুন কমিটি নিয়ে কেটে যায় সকল শঙ্কা। তবে নতুন বছরের শুরুতেই আসন্ন সরকার পতন আন্দোলন সফল করা নিয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে ছাত্রদলকে।

No comments

Powered by Blogger.