‘আমি আমার বাচ্চা ফেরত চাই’

‘আমার বাবা ছোড হাত দিয়া দড়ি ধইরা রাখতে পারে নাই। ও আবার পইড়া গ্যাছে। আমি কি আমার বাচ্চা লুকাই রাখছি? আমি আমার বাচ্চা চাই। জানের বদলে জান হইলেও আমি আমার বাবারে চাই।’
অস্পষ্টভাবে এভাবে বিলাপ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন খাদিজা। এরপর আর কোনো কথা নেই। এরপর আবার বুকফাটা বিলাপ, ‘বাবারে তুই কই গেলি রে।’
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর শাহজাহানপুরের রেল কলোনির বাসায় গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়।
ছোট শিশুটির নাম কেউ বলছে জিহাদ। অনেকে বলছে জিয়াদ। একজন জানালেন, এলাকার সবাই ওকে জিয়া নামেই ডাকত। শুক্রবার বিকেল থেকে সে নিখোঁজ। পরিবারের দাবি, বাসার কাছে পরিত্যক্ত গভীর পানির পাম্পে সে পড়ে গেছে। গণমাধ্যমে ছোট শিশুর সেই উদ্ধারচিত্র দেখে সকাল থেকেই অনেকে ছুটে এসেছেন শিশুটির মাকে একনজর দেখতে। খাদিজাকে একনজর দেখার জন্য ছোট তিন রুমের বাসাটিকে কেন্দ্র করে রীতিমতো ভিড় লেগে রয়েছে। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ভেতরে যাওয়ার সুযোগ মিলছে। একনজর দেখার পর যাতে লোকজন তাড়াতাড়ি বের হয়ে যান, তার জন্য অনুরোধ জানাতে হচ্ছে। গেন্ডারিয়া থেকে একজন বয়স্ক নারী এসেছেন। তিনি খাদিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সেখানে দুজন পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। পাম্প ঘিরেও প্রচুর ভিড়।
শিশুটির পানির পাম্পে পড়ে যাওয়ার বিষয়টি গুজব বলেও কথা উঠেছে। উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও শেষ পর্যন্ত পানির পাম্পের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব না পেয়ে বিষয়টিকে গুজব বলেছেন। তবে এ কথা মানতে চাচ্ছেন না খাদিজা। তিনি বললেন, ‘আমি কি আমার বাচ্চারে লুকাই রাখছি?’
খাদিজার দূর সম্পর্কের ভাই আর কে জুয়েল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ও যে পড়ছে, তা অন্যরাই বলছে। গণমাধ্যমেই খবর প্রকাশ করছে যে জিয়াদ পাম্পের মধ্যে বসেই জুস খাইছে। জুসের খালি প্যাকেট ভেতর থেকে বাইরে আনছে। তাইলে জুসটা খাইল কে?’
জিয়াদের বাবা মতিঝিল মডেল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের দারোয়ান নাসির উদ্দিন গতকালের পর আর বাসায় ফেরেননি। পরিবারের লোকজন শুনেছেন, তাঁকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন আর কে জুয়েল। তিনি বলেন, ‘বাবাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার কারণ কী, তা আমরা বুঝতে পারছি না।’
কলোনিটি রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য। তবে নাসির উদ্দিন রেলওয়ের কর্মচারী নন। তিনি পাঁচ হাজার টাকায় দোতালার তিনটি রুম ভাড়া নিয়েছেন। তারপর সেখান থেকে এক রুম সাবলেট দিয়েছেন। ঘরে আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। ড্রেসিং টেবিলের ওপরে হ্যাঙ্গারে ঝুলছে জিহাদের কয়েকটি কাপড়। ঘরে যে চৌকির ওপর খাদিজাকে ঘিরে কয়েকজন বসে ছিলেন, প্রতিবেদকের উপস্থিতিতেই সে চৌকি ভেঙে যায়। তারপর খাদিজাকে সিঁড়ির কাছে তোষকের ওপর নিয়ে বসানো হয়। সকাল থেকে খাদিজাকে কিছু খাওয়ানোর জন্য তোড়জোড় চলছিল। তবে খাদিজা কিছুই মুখে দিচ্ছিলেন না। খাবার মুখে নিয়েই আর্তনাদ করছেন। ঘরের মধ্যে প্রতিবেশীরা দুপুরের রান্নার আয়োজন করছেন।
খাদিজার বড় মেয়ে স্বর্ণা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। সে জানাল, সব সময় জিয়াদ একা বের হয়ে যেত। তবে পানির পাম্পের কাছে আগে কখনো যায়নি। ঘটনার দিন দুপুরে স্বর্ণা ও তার আরেক ভাই মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল। সুযোগ পেয়ে ছোট ভাই একা একা বাইরে চলে যায়।

No comments

Powered by Blogger.