পদ্মা নদী এখন ধু-ধু বালুচর

পদ্মা নদী এখন বালুচরে পরিণত হয়েছে। নৌকার বদলে এখন চলে ঘোড়ার গাড়ি। পায়ে হেঁটে এপার থেকে ওপারে যায় দু’পাড়ের মানুষ। সরজমিন দেখা যায় পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে নদীর বুকজুড়ে ধু-ধু বালুচর। রেল সেতু ও সড়ক সেতুর নিচে চাষাবাদ হচ্ছে। নদীর পানি প্রবাহ একেবারেই স্থির। অন্যদিকে পাবনা শহর থেকে দক্ষিণে ৬ কিলোমিটার দূরে পদ্মার বাম তীর। এখান থেকে পদ্মার ওপারে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ী। নদী এখানে শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুক চিরে প্রায় ৫ কিলোমিটার শুধু ধু-ধু বালুচর। এ বালুচরের মাঝে দু’টি স্থানে পানির সরু চ্যানেলে নৌকা রয়েছে। নৌকায় চড়ে মানুষ পার হয়ে বালুচরে আবার হাঁটতে হয় ৫ কিলোমিটার। এক সময়ের প্রমত্তা নদীর বালুচরেই এখন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রতিদিন মানুষ নদী পারাপার হচ্ছে। পদ্মা পারের আবদুস সাত্তার জানান, শীতের মওসুমেও পদ্মার ইলিশ দিয়ে তারা ভাত খেতেন। প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত পদ্মায়। কিন্তু এক সময় যেখানে তিনি মাছ ধরেছেন বর্তমানে সেখানে এবার চিনাবাদাম চাষাবাদ করছেন। পানির লেশমাত্র নেই পদ্মার দুই কূলে। ১৯৯৭ সালে ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের অংশে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি কার্যকর শুরু হলেও ওই চুক্তির পর বাংলাদেশ কখনও ন্যায্য হিস্যার পানি পায়নি। তবু প্রতি বছর চলে চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা। ১৮তম বর্ষে পা দিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা পানিচুক্তি। বাংলাদেশের পক্ষে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের পক্ষে সে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের হায়দারাবাদ হাউজে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি পানিচুক্তি স্বাক্ষর হয়। ৩০ বছর মেয়াদি পানি চুক্তির সিডিউল অনুযায়ী প্রতি বছর শুষ্ক মওসুমের ৫ মাস অর্থাৎ ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত এ চুক্তি কার্যকর হয়ে আসছে। পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে এই পানির প্রবাহ পরিমাপ করা হয়। দু’দেশের প্রকৌশলী ও পানি বিশেজ্ঞরা প্রতি মাসে ৩ দফা অর্থাৎ ১০ দিন পরপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করে তা যৌথ নদী কমিশনের কাছে উপস্থাপন করে। চুক্তির ২ নম্বর অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারায় গত ৪০ বছরে (১৯৪৯-৮৮) পানি প্রবাহের গড় ভিত্তিতে একটি সিডিউল নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সিডিউল অনুযায়ী ১ থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের পানি পাওয়ার কথা গড়ে ৬৭ হাজার ৫শ’ ১৬ কিউসেক। এই কার্যক্রম ৩১ মে পর্যন্ত চলবে। বিভিন্ন প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের মধ্যে অবস্থিত গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা পয়েন্টে ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে ভারত চালু করে। আর তখন থেকেই বাংলাদেশের পদ্মা নদীর এ করুণ দশা। যা আজ মরুকরণে পরিণত হয়েছে। সে সময়ের শেখ মুজিব সরকারের পানি সম্পদমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক দু’দেশের মধ্যে খসড়া এক সমঝোতা স্বাক্ষরে ভারত গঙ্গার ১১০০ থেকে ১৫০০ কিউসেক পানি প্রত্যারের অনুমতি পায়। এরপর ১৯৭৬ সালে কোন চুক্তি না থাকায় ভারত একতরফা গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে। এরপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৭ সালে ৫ নভেম্বর তৎকালীন সরকার শুষ্ক মওসুমে (জানুয়ারি থেকে মে) গঙ্গার পানি প্রবাহের বিষয়ে ৫ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিতে ২১ থেকে ৩০ এপ্রিল ১০ দিন ভারত ফারাক্কার বিকল্প খাল দিয়ে কলকাতা বন্দরের জন্য ২০,৫০০ কিউসেক পানি নিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের জন্য ৩৪,৫০০ কিউসেক পানি বরাদ্দ করা  হয়। এ চুক্তিতে গঙ্গার পানি প্রবাহের শতকরা ৮০ ভাগ প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়। ওই চুক্তিতে দু’দেশের সরকারি পর্যায়ে প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যুক্ত কমিশন গঠন করা হয়। যা এ কমিশন ৩ বছরের মধ্যে ও পানিবন্টন চুক্তি ও ফারাক্কায় গঙ্গার পানি বৃদ্ধি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করবে। কিন্তু নদীর পানিবন্টন নিয়ে দু’দেশের ভিন্ন ভিন্ন মত ও প্রস্তাব থাকায় কোন দেশই এ ব্যাপারে একমত হতে পারে না। ফলে ১৯৭৭ সালের পানিচুক্তি ১৯৮২ সালের নভেম্বরের পর  আর নবায়ন হয়নি।
এরপর ৪র্থ পর্যায়ে ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালের শুষ্ক মওসুমে পানি বণ্টনের জন্য ১৯৮২ সালের অক্টোবর মাসে দু’দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং-১৯৮২) স্বাক্ষরিত হয়। এ স্মারকে পানি প্রবাহের ন্যূনতম সুযোগ না রেখে পানি ধারণ ক্ষমতার হিস্যা এর শর্ত রাখা হয়। এরপর আর চুক্তি না হওয়ায় ১৯৮৫ সালের শুষ্ক মওসুম পানি থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। এরপর ১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। ওই স্মারকে ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত শুষ্ক মওসুমের জন্য পূর্বের মতো পানি প্রবাহের ন্যূনতম সুযোগ রাখা হয়নি। এরপর উভয় দেশ পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালের পর থেকে চুক্তির বিষয়ে আর সমঝোতায় আসতে না পারায় ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সাল অর্থাৎ ৯ বছর একতরফা ভারত গঙ্গার পানি বিকল্প সংযোগ খালের মাধ্যমে হুগলী নদীতে নিয়ে যায়। এর ফলে দীর্ঘ ৯ বছর পদ্মা নদীতে কাঙ্ক্ষিত পানি না থাকায় বাংলাদেশের ওপর ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব পরে। এতে দেশের দক্ষিণা-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য মিঠা পানির প্রধান উৎস এবং পদ্মার প্রধান শাখা গড়াই নদী শুষ্ক মওসুমে শুকিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, পদ্মা শুকিয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। পদ্মার সঙ্গে সংযোগকারী অন্যান্য নদীও  শুকিয়ে যাওয়ায় দেশের পদ্মা নদী প্রবাহিত এলাকার দু’পাশের জেলাতে সেচনির্ভর কৃষি ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ে ব্যাপক প্রভাব। গঙ্গা থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ইতিহাসের সর্বনিম্ন (৯ হাজার ২১৮কিউসেক) পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতীত রেকর্ড থেকে জানা যায়, এ সময়ে এ পয়েন্টে সর্বনিম্ন প্রবাহ থাকে কমপক্ষে ৭৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার কিউসেক। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত ৩০ বছর মেয়াদি পানি চুক্তি স্বাক্ষর করে। যা ১৯৯৭ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩০ মে প্রতিবছর শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি হয়ে আসছে। কিন্তু এ চুক্তি নিয়ে রয়েছে দেশের পানি বিশেষজ্ঞদের নানা প্রশ্ন।

No comments

Powered by Blogger.