‘প্রতিদিনই ওদের স্মরণ করি’

‘আমি প্রতিদিনই ওদের স্মরণ করি।’
(সুনামির এক দশক পূর্তি উপলক্ষে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সাগরে গোলাপ ফুল ভাসিয়ে দিচ্ছে থাইল্যান্ডের শিশুরা। ছবিটি আজ ফাং এনগা প্রদেশের বান নাম খেম সুনামি পার্কের কাছ থেকে তোলা। ছবি: এএফপি) বেদনা ভরা হৃদয়ে এ কথা বলেন থাইল্যান্ডের এক মা। সমজাই সমবুন তাঁর নাম। বয়স ৪০ বছর। আজ থেকে ঠিক ১০ বছর আগে, ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভয়াল এক দানব এসে তাঁর বুক থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে দুই ছেলেকে। তাদের স্মৃতি এখন তাঁর চিরকালের দহন। যে দানবটার কথা বলা হলো, তা ছিল ভারত মহাসাগরের প্রলয়ংকরী সুনামি। ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমে সাগরের তলদেশে ৯ দশমকি ৩ তীব্রতার ভূমিকম্পের আঘাতে দেখা দেয় এই সুনামি। পাহাড়প্রমাণ উন্মত্ত ঢেউ এসে প্রচণ্ড বেগে হামলে পড়ে ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশগুলোতে। লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় অনেক জনপদ। কেড়ে নেয় দুই লাখ ২০ হাজার লোকের প্রাণ। সেই সুনামির ১০ বছর পূর্তিতে সুনামির আঘাত সওয়া দেশগুলোতে আজ গভীর বেদনা নিয়ে স্মরণ করা হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের।
ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও সোমালিয়াসহ ১৪টি দেশে আঘাত হানে সুনামি। সাগরের মাতাল ঢেউয়ের সেই ধ্বংসযজ্ঞের রেশ কেটে গেছে, কিন্তু ধাক্কা সয়ে টিকে থাকা মানুষজনের সেই আতঙ্ক কাটেনি এখনো। মসজিদ, মন্দির ও গির্জায় গিয়ে তাঁরা এখন প্রার্থনায় মগ্ন। যাঁরা ঝরে গেছেন, তাঁদের আত্মা যেন শান্তি পায়। আর কখনো যেন এমন ভয়াল ঢেউ এসে আঘাত না হানে।
আজ বার্তা সংস্থা এএফপি খবরে জানানো হয়, আজ সকালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচেহ এলাকার ২০-একর পার্কে দেশটির জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেখানে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট জুসাফ কাল্লাসহ হাজারো মানুষ উপস্থিত হয়েছেন। সুনামির সময় এখানেই ১১৫ ফুট উঁচু থেকে আছড়ে পড়েছিল জলোচ্ছ্বাস। আর সুনামির আঘাতে মোট নিহতের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় নিহত হয় এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ।
জুসাফ কাল্লা বলেন, ‘এই মাঠে হাজারো মানুষের লাশ পড়ে ছিল। তখন অনেক মানুষের অশ্রু ঝরেছে...দ্বিধা ছিল, বেদনা ছিল, ছিল দুঃখ, ভয় আর দুর্ভোগের অনুভূতি।’ সব মানুষের সহায়তায় কীভাবে সেই দুর্যোগ কাটিয়ে আবার দাঁড়াতে পেরেছে এখানকার মানুষ, সে কথা বর্ণনা করেন তিনি। এ সময় অনেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।
থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে প্রলয়ংকরী সুনামির আঘাতে নিহত হয়েছিল পাঁচ হাজার ৩০০ মানুষ। এঁদের মধ্যে অর্ধেক ছিলেন বিদেশি পর্যটক। তাঁদের স্মরণে আজ বান নাম খেম গ্রামের মেমোরিয়াল পার্কে সমবেত হয়েছেন শত শত মানুষ। এতে অংশ নেন সেই বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ ও উদ্ধারকর্মীরাও।
সুনামির সময় থাইল্যান্ডে ছিলেন সুইস নাগরিক রেমন্ড মুর। স্মৃতি আওড়ে তিনি বলেন, সেদিন সকালে স্ত্রীর সঙ্গে বসে নাশতা করছিলেন। হঠাৎ দেখেন দিগন্ত থেকে সবেগে ধেয়ে আসছে বিশাল ঢেউ। তিনি তাঁর স্ত্রীকে দৌড়ে পালানোর পরামর্শ দেন। তাঁর ভাষ্য, ‘ওটা কোনো ঢেউ ছিল না। ছিল একটি কালো দেয়াল।’
আন্তর্জাতিক স্মরণ অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে এই দিনটি পালন করছে সুইডেনও। এই সুনামি সে দেশের ৫৪৩ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আজ দুপুরে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে আপসালা গির্জায় প্রার্থনায় অংশ নেবে দেশটির রাজপরিবারসহ সেই বিপর্যয়ে নিহতদের স্বজন ও বেঁচে যাওয়া মানুষেরা। সুনামিতে সুইডেনে প্রায় ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।
শ্রীলঙ্কার রেলস্টেশনে যাত্রীবাহী একটি ট্রেনের ওপর আছড়ে পড়েছিল সুনামি। ওই ট্রেনে থাকা যাত্রীদের মধ্যে এক হাজার ৫০০ জন যাত্রী মারা গিয়েছিলেন সেদিন। এ ছাড়া প্রায় ৩১ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। আজ ওই রেলস্টেশনে নিখোঁজ ও মৃত ব্যক্তিদের স্মরণে সমবেত হবে মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.