আন্দোলন মোকাবেলায় নতুন কৌশল by জাকির হোসেন লিটন

মাঠ দখলের প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের - বিএনপি জোটকে বিভ্রান্ত করতে ডিসিসি নির্বাচনের পরিকল্পনা
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ঈদ-পরবর্তী সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবেলায় নতুন ছক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে সহিংসতা দমনের নামে সারা দেশে কয়েক দফা গণগ্রেফতার সেরে ফেলেছে প্রশাসন। বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত পুরনো মামলা সক্রিয় করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। আন্দোলন চাঙ্গা হলে এসব মামলায় আবারো গ্রেফতার অভিযান শুরু হবে। সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনের পাশাপাশি রাজপথও দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা। সেই লক্ষ্যে শিগগিরই তৃণমূল সম্মেলনের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের নতুন করে চাঙ্গা করা হবে। সরকারি দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বিএনপিকে বিভ্রান্ত করতে সরকার ভিন্ন উপায়ও গ্রহণ করতে পারে। সেই লক্ষ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই অংশের নির্বাচনের বিষয়টিও মাথায় রেখেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। পরিস্থিতি বুঝে এ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপিকে আন্দোলনে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হতে পারে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ঈদের পর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এতে আবারো রাজপথ উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ২০ দলীয় জোট নেতারা বলছেন, আন্দোলনে কোনো ধরনের বাধা দেয়ার চেষ্টা হলে পাল্টা আঘাত করা হবে। প্রয়োজনে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিও ঘোষণা করা হতে পারে। বিরোধী জোটের আন্দোলনের হুমকির বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা। সে জন্য গত ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভায় ঈদের পর তৃণমূল সম্মেলনের তাগিদ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের কঠোর হুঁশিয়ারি দেন তিনি। আগামীকাল রোববার আবারো বসছে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিতব্য এ বৈঠকে লতিফ সিদ্দিকীর বহিষ্কারের বিষয় ছাড়াও বিএনপি জোটের আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র ১৪ দলের শরিকদের এক বৈঠকে ঈদের পর ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের হুমকির বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এ সময় বিএনপির আন্দোলন মোকাবেলায় শরিক সংগঠনগুলোর মতামতও জানতে চাওয়া হয়। এ সময় বলা হয় শিগগিরই ১৪ দলের বৈঠক ডেকে আন্দোলন মোকাবেলার ছক তৈরি করা হবে।
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবেলায় প্রশাসনিক পদক্ষেপের সাথে রাজপথে তাদের সাংগঠনিক কর্মসূচি থাকবে। বিএনপি জোট যাতে কোনোভাবেই রাজপথ দখলে নিতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ থাকবে তারা। পাশাপাশি ঢাকায় যাতে কোনোভাবে আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে সে জন্য বিভক্ত ডিসিসির দুই অংশের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিও নতুন করে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এ কারণে ডিসিসিতে রাজনৈতিক প্রশাসক নিয়োগের উদ্যোগ থেকে সরে এসেছে সরকার। সরকারবিরোধী সম্ভাব্য কঠোর আন্দোলনের সময় ডিসিসির নির্বাচনের হুজুগ তুলে সেই আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতেই এ কৌশল নেয়া হতে পারে। সম্প্রতি ধানমন্ডিতে অনুষ্ঠিত মহিলা আওয়ামী লীগের এক বৈঠক থেকে নেতাকর্মীদের সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানায় সূত্রটি।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগের পরিস্থিতিতে দেশ ফিরে যাক মতাসীনেরা তা কোনোভাবেই চান না। সম্প্রতি দলের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের অস্থিরতার আগেই তা সামাল দিয়েছে সরকার। লতিফ সিদ্দিকীকে সরকার ও দলের সব পদ থকে অব্যাহতি দেয়ার ঘোষণায় আপাতত সরকারবিরোধী আন্দোলনের বড় একটি ইস্যু শেষ করে দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি ও তার মিত্রদের সহিংস হয়ে উঠতে দেয়া হবে না। তাই বিএনপির প থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঘোষণা আসার পরপরই সরকারের নীতিনির্ধারক মহল তৎপর হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে তারা আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, র‌্যাব, পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে একাধিক বৈঠক করেছেন। নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত এবং তারও আগে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থারও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরে সারা দেশে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৯ হাজারের মতো মামলা করা হয়। নির্বাচনের আগে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতার সাত শতাধিক মামলা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় এক শ’র কাছাকাছি মামলা রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার মামলার খড়গ রয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর। এসব মামলার অর্ধেকের তদন্ত শেষে চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে। এখন আন্দোলনের ঘোষণার পর বাকি মামলা তদন্তের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জেলা-উপজেলায় পুলিশের মামলা তদন্তের এ মিশন মূলত বিরোধীদের শক্তি সঞ্চয়ে বাধা দেয়ারই কৌশল। একই সাথে যুক্ত হবে নতুন নতুন আরো অনেক মামলা।
এ দিকে আন্দোলনের নামে সব ধরনের নাশকতা বা জ্বালাও-পোড়াও রোধে পুলিশ, র‌্যাব এবং সব ক’টি গোয়েন্দা সংস্থা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। পাশাপাশি তারা আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জামও মজুদ করছে। বিরোধী নেতাকর্মীরা রাজপথে সহিংস হয়ে উঠলে প্রশাসনিকভাবে তা দমন করার নির্দেশ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর ওপর।
অন্য দিকে রাজধানীতে বিরোধী দলকে মোকাবেলায় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যে শিগগিরই মহানগর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির ঘোষণা আসতে পারে। নতুন নেতৃত্ব পেলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ স্থবিরতা কাটিয়ে গতিশীল হবে বলে আশা করছেন নীতিনির্ধারকেরা। একই সাথে সারা দেশে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করা হবে।
ঈদের পর বিএনপির আন্দোলনের হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে যত আন্দোলনই হোক, লাভ নেই। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে মতায় এসেছেন।
দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূহ উল আলম লেনিন বলেন, বিএনপি শুধু লাফালাফি করতে পারে, আন্দোলন করতে পারে না। তাদের আন্দোলন হচ্ছে খুনোখুনি আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাক হত্যার টার্গেট; কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বেঁচে থাকতে তা হতে দেয়া হবে না। তারা কোনো ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইলে প্রশাসনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও মাঠে থাকবে।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি বলেন, যেকোনো গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে তাদের বাধা নেই। তবে যদি কর্মসূচির নামে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর করা হয় তাহলে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী তা দমন করবে।
দলের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: দীপু মনি এমপি বলেন, তাদের হুমকি-ধমকির কোনো অর্থ নেই। কারণ আন্দোলন মানুষ ছাড়া হয় না; কিন্তু তাদের আন্দোলনে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সে জন্য অতীতে তারা সফল হতে পারেনি আর ভবিষ্যতেও পারবে না। আসলে তারা আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাওয়ার নিরলস প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। কারণ তারা তো এ দেশটাকেই চায়নি। তবে শান্ত এ দেশে নতুন করে অস্থিরতার চেষ্টা করা হলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.