বিভ্রাট, উপেক্ষা এবং বৈপরীত্য by সাকিব সাদমান

বাংলাদেশ মেডিক্যাল কাউন্সিল রীতিমতো গাঁটের পয়সা খরচ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান দিচ্ছে, কোন কোন ডিগ্রি চিকিৎসকগণ নামের পাশে ব্যবহার করতে পারবেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া এখন অনেক খরচের ব্যাপার। বিশেষ করে কয়েকটি দৈনিক বছরে কয়েকবারই তাদের বিজ্ঞাপনের রেট পরিবর্তন করছে (আহা, এভাবে বছরে দু’বার বেতনের রেটটা বদলে গেলে কতই না আরাম হতো! 'বললেন, একজন সরকারি চাকরিজীবী)। অনুমান করা সহজ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কাউন্সিল পর্যাপ্ত ত্যক্তবিরক্ত হয়েই এমন একটি বিজ্ঞপ্তি দিনের পর দিন প্রচার করেছে। কেবল গ্রামের সাধারণ মানুষই নয়, অনেক লেখাপড়া করেও (পড়ুন, সার্টিফিকেট গ্রহণ করেও) ডাক্তারি ডিগ্রির বহর ঠিকমতো ধরতে পারি না আমরা অনেকেই। কিছু চিকিৎসক অবিরাম এ সুযোগটিই গ্রহণ করছেন। শহর থেকে গ্রামে বা মফস্বল শহরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা (পড়ুন, অর্থ উপার্জন) দিতে এসব ডিগ্রি-পদবি অনেক কাজ দেয়' এ কথাটা সাধারণদের চেয়ে অনেক ডাক্তার ভালো জানেন। ডিগ্রি, সেটা যদি বিদেশী পদবাচ্যের হয়, তবে আর পায় কে! বিদেশী ডিগ্রির বহর দেখলে অনেকেই আবার বেশি বেশি আস্থায় নিয়ে নেয় ডাক্তারদের। বিদেশী ডিগ্রি ছাড়াও যদি একের অধিক ডিগ্রি বা পদবি নামের সাথে যুক্ত হতে পারে, তাহলেও রোগী পেতে (পড়ুন, রোজগারে) সুবিধা। ফলে বিদেশী কিংবা বিদেশী না হলেও হরেক প্রকারের দেশী ডিগ্রি আর পদবি ব্যবহারের একটা প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়। আবার ডিগ্রিবিহীন ডা: কদম আলীদের একাংশও মাঝে মাঝে ধৃত হচ্ছে মর্মে খবরে দেখা যায়।
আমাদের চিকিৎসকগণ আবশ্যিকভাবেই শিক্ষিত আর সচেতন শ্রেণীর মানুষ। সেই তাদেরকে এখন বিজ্ঞাপন দিয়ে সতর্ক করতে হচ্ছে। তাহলে বাকিদের অবস্থা কী হতে পারে! আমাদের ডাক্তারদের কেউ কেউ সাত থেকে দশ দিনের ট্রেনিংও নামের সাথে জোড়াতাড়া করতে চান- কী এক পাগলামি! দু-এক মাসের প্রশিক্ষণ হলে তো কথাই নেই। পদবির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কবে কোন সেমিনারে বিদেশ গেছেন তাও ভিজিটিং কার্ডে লেগে যাচ্ছে অবলীলায়। পিজিটি ডিগ্রির মাহাত্ম্য বোঝা দায়, কিন্তু মফস্বলের অনেক চিকিৎসকের নামের সাথে এটি দেখা যায়; যেমন আগে চোখে পড়তÑ বিএইচএস (আপার), বাংলাদেশ মেডিক্যাল সার্ভিস (আপার)। কাগজপত্র সাক্ষ্য দিচ্ছে, এ দেশে মেডিক্যাল সার্ভিসে আপার-লোয়ারের ধারণা কস্মিনকালেও ছিল না। পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা বলে কিছু একটা আছে, তার গুরুত্বও কম নয়। কিন্তু পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং নামের সাথে একদম যায় না। বিদেশীরা এসব দেখে হাসছে কেবল। সাইনবোর্ড, প্যাড, নেমপ্লেট, ভিজিটিং কার্ডÑ সর্বত্রই এই মশকারা প্রতিভাত। কালই গ্রিন রোড দিয়ে আসতে চোখে পড়ল, একজন মেডিসিনের প্রফেসরের (তিনি আবার মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডিন, সেটিরও জানান দেয়া হচ্ছে রোগী শিকারের সাইনবোর্ডে) সাইনবোর্ডের বাঁ দিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম। খুব জোর দিয়েই বলছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় অনেক জ্ঞানীগুণী, কিন্তু তিনি কি সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করবেন? উত্তর, অবশ্যই না। তাহলে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করছেন কাকে বিভ্রান্ত করতে? একটা উত্তর হতে পারে, তিনি দেখেননি, হয়তো কোনো ওষুধ কোম্পানি এটি বানিয়ে দিয়েছেন। কিংবা বানিয়েছেন কিনিকের মালিক। এটি কোনো কাজের কথা হতে পারে না। আমার ভিজিটিং কার্ড, আমার নামের সাইনবোর্ড আমি দেখব না কিংবা সেটি বানিয়ে আনার পরও আমার চোখে পড়বে নাÑ হতেই পারে না। ডাক্তার সাহেব অন্ধ না তো (জ্ঞানান্ধ তো হতেই পারে!)! এই হচ্ছে সমাজের উচ্চস্তরের একজন মানুষের মাত্রাজ্ঞান। তবে তার নামের পর দু-দুটো বিদেশী ডিগ্রি মেডিক্যাল কাউন্সিলের বিজ্ঞাপন মতে অনুমোদিত কি না তা বোঝা যায়নি। বস্তুত এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়, মেডিক্যাল কাউন্সিলের বিজ্ঞাপনটি ডাক্তারদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। এ যাবৎ কারো ভিজিটিং কার্ড, প্যাড, সাইনবোর্ড বদলে গেছে খালি চোখে মালুম হয় না তা। বিএমডিসিকে হয়তো এ জন্য বড় কোনো অ্যাকশনে যেতে হবে। নৈরাজ্য দূর করতে এর কোনো বিকল্প নেই।
সর্বত্রই এই অবস্থা। শিক্ষক নামের পর ব্যবহার করছেন ফার্স্টকাস ফার্স্ট অথবা গোল্ড মেডালিস্ট। এতে বেশি বেশি ছাত্র পড়াতে সুবিধা হয়, না অর্থলাভে সুবিধা হয় বোঝা দায়। তবে এটি নামের পর, তা ভিজিটিং কার্ডই হোক বা সাইনবোর্ডই হোকÑ ব্যবহারের জন্য কোনো বিষয় হতে পারে না। শেষ অবধি ইউজিসি কিংবা শিক্ষা অধিদফতর থেকে বিজ্ঞাপন জারি করতে হবে কি না এখনো মালুম করা যাচ্ছে না (এখন মন্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে সেটিরও জানান দিতে হয় ভিজিটিং কার্ডেÑ স্বনামধন্য শিক্ষকের কাণ্ড এটি। হায় হায়! )। সরকারের সাথে যৌথভাবে কাজ করে কোনো কোনো এনজিও কর্মী সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করছেÑ সম্পূর্ণ বেআইনি তা। আমাদের তিন বাহিনীর অফিসারেরা অবসরের পর তাদের পদবি ব্যবহার করেন। পৃথিবীর সর্বত্রই এটি স্বীকৃত। কিন্তু আগে সবাই পদটির পর ব্র্যাকেটে অবসর লিখতেন। এখন লিখছেন নামের শেষেÑ বিভ্রান্ত হই, কোনটি সঠিক সেটি ভেবে। একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেনের বাসার গেটে নেমপ্লেটে ১৫ বছর ধরে ক্যাপ্টেন (অব:) দেখে আসছি। পরিচিতজনরা দায়িত্ব নিতে নারাজÑ সে বোধকরি পদোন্নতি পেয়ে ক্যাপ্টেন হয়েছেন বলেই। প্রশ্ন হচ্ছে, ভদ্রলোক না হয় পদোন্নতি কিংবা অনারারিই পেলেন, কিন্তু জীবনভর কী শিখলেন! তার বসরা কি কেউ ক্যাপ্টেন লিখেছেন কখনো?
এবার পেশাজীবীরা পিছিয়ে থাকবেন কোন দুঃখে? তারাও নামের পর ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ ব্যবহার করছেন। কার্ডে আরো কী সবÑ কে বলবে ইঞ্জিনিয়ার কিংবা কৃষিবিদ সমিতিকে আবার কবে বিজ্ঞাপন দিয়ে এসব ঠিক করে দিতে হয়! আমাদের কিছু পীরের নামের পর আবার কী সব লেখা হয় বোঝাই দায়। যা বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারেন না, সেটি ব্যবহারের তাৎপর্য সেই তারাই বলতে পারবেন। একই অবস্থা গ্রাম্য-কবরেজদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মানলাম, তার অনেকটাই না বুঝে। কিন্তু আমাদের আইনজীবীদের হাতে কৌঁসুলি শব্দটার একদম বারোটা বেজে গেছে। বেশির ভাগই এটিকে চন্দবিন্দু ছাড়া (তাও হতে পারে) এবং ‘স’-এর বদলে ‘শ’ এবং দীর্ঘ-ঈ কার দিয়ে লিখছেন। বিএমডিসি যখন বিজ্ঞাপন দিয়ে ডিগ্রি কাটছাঁট করতে চাইছে, ঠিক সে রকম সময়ে নারায়ণগঞ্জে একজনের দেখা মিলেছে, যিনি বার এট ল করেও সেটি কোথাও লেখেন না। বছর বিশেক আগের ঘটনা। বাবার ইচ্ছেতে ঢাকা ছেড়ে যাদবপুর গেছেন ইংরেজি পড়তে। ভর্তির পর পঁয়ত্রিশ-চল্লিশজন শিক্ষকের কারো নেমপ্লেটে নামের আগে ড. না দেখে মনটন খারাপ হয়ে গেলÑ তখন ঢাবির ইংরেজি বিভাগে ছয়-সাতজন ডক্টরেটধারী পড়াচ্ছেন। শেষ অবধি বিভাগের অফিসে খোঁজ নিতেই হলো। বিভাগের কেরানি জানালেন, সাঁইত্রিশ শিক্ষকের চৌত্রিশজনই পিএইচডিধারী; তাই কেউ আর লিখছেন না, আর বাকিরা তখনো বেশ জুনিয়র।
নৈরাজ্য, না অবহেলা, না উপেক্ষা জানি নাÑ বানান নিয়ে তুলকালাম ব্যাপার। সরকার বলছে, এখন বাংলা একাডেমির বানানরীতি অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু সরকারি দফতরগুলোই সেটি যথাযথভাবে অনুসরণ করছে না। পিএসসির সামনে এখনো বিশালাকৃতির সাইনবোর্ড জানান দিচ্ছে, ‘সরকারি’ নয়, ‘সরকারী’। চিঠিপত্রে সরকারি ব্যবহৃত হলেও একই চিঠিতে বিভিন্ন আইনের উল্লেখে লিখতে হচ্ছে ‘সরকারী’Ñ হয়তো এটাই অতি দরকারি; কারণ আইনে বর্ণিত শব্দাবলির বানান বদলায় কার সাধ্য! সরকারি ঘোষণার পরও সংবিধানের বাংলা ভাষ্যের প্রমিত বানান নিয়েও সবাই নির্বিকার। টেক্সট বুক বোর্ডের বইয়ে প্রমিত বানানরীতি ব্যবহারের কথা আছে। হচ্ছে না। বরং একই শব্দের বানান একাধিক ঢঙে আছে। ছেলেমেয়েরা কোনটি লিখবে? কোনো কোনো পত্রিকা নিজেদের উদ্ভাবিত বানানরীতি চালু করেও ছেলেমেয়েদের বিপাকে ফেলেছে। সকালে বাসায় কাগজে পড়ছে, ‘বুদ্ধিজিবি’। স্কুলে গিয়ে শিখছে ‘বুদ্ধিজীবী’। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসের চিঠিতে কেবল সাধু-চলিতের মিশ্রণই নয়, নানা প্রকারের ভুলে আকীর্ণ থাকে। এখন নেই, ছিলেন; একজন মুখ্যসচিবের একটি আধা সরকারি পত্রে গোটা সাতেক লাল রঙের দাগ পড়েছিল। আবার মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে লেখা হচ্ছে মূখ্য সচিব। খ-এর ওপর একটা রেফ দিলেই সর্বনাশটা হতে বাকি থাকত না (নাকি, জুনিয়ররা ভুলেভালে মূর্খই লিখতে চাইছে। ছি:! সেটা হয় কী করে!) শিক্ষকদের ভুল বানানও ছাত্রছাত্রীদের কম উচিত শিক্ষা দিচ্ছে না। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ কেবল অধ্যক্ষের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হতে পারেনি। তবে অধিভূক্ত হতে পেরেছে ( দেখুন, সাম্প্রতিক সময়ের দু-দুটো সাইনবোর্ড)। বালিকা উচ্চবিদ্যালয়কে এই রাজধানীতেও উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় লিখতে দেখা যায়। গরু খাঁটি, নাকি দুধ খাঁটি সেটি নিয়ে কথা হওয়ার মতোই ব্যাপার।
জরুরি আইনের সময়ে এক মেজরের এক পৃষ্ঠার চিঠিতে তেরটি বানান ভুল। সিও’র দৃষ্টি আকর্ষণের পর সেটি ফিরিয়ে দিতে হয়েছে কোনো এক ডিসিকে। কাউকে না জানানোর অনুরোধও ছিল। পরে দেখা গেল, সার্কিট হাউজে সব ফৌজির টেবিলে বাংলা একাডেমির অভিধান শোভা পাচ্ছে। বলা বাহুল্য, শোনা গল্প এটি। এখনকার আধুনিক ছেলেমেয়েরা বেশ সচেতন। কিন্তু তিন-চার বছর আগের আইনেও বানান ভুল মিলবে হরহামেশা। অথচ এই আইনটি কত হাত হয়েই না আমজনতার হাতে পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রীকে প্রেরিত সারসংক্ষেপেও ভুল বানানের অস্তিত্ব বিদ্যমান; যদিও উঁচু আমলার হাত হয়েই এটি যাচ্ছে। শ্রদ্ধাঞ্জলি নিয়ে কতই না কী ঘটল! কাগজে অনুরোধও করতে দেখা গেছে অনেকবার। এখন ঠিকঠাকই লেখা হচ্ছেÑ কেবল রাস্তার সস্তা রাজনৈতিক পোস্টার ব্যতিরেকে। এসব পোস্টারের বানান আর ভাষাশৈলী সত্যিই আলোচনার দাবি রাখে।
হ্রস্ব ই-কার আর দীর্ঘ ঈ-কারের বিবাদ মিটতে সময় লাগবে হয়তো। কিন্তু হ্রস্ব উ-কার আর দীর্ঘ ঊ-কারের বিবাদও মিটছে না। সড়ক বিভাগের সাইনবোর্ডে দুর্ঘটনা যেন ঘটিয়েই দিচ্ছে। অনেক দামি এসব সতর্কবার্তায় কী করে দীর্ঘ ঊ-কার হলো বোঝা দায়। হালে অগ্নিনির্বাপণ দফতর দুর্যোগ আর দুর্ঘটনার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। যতটা মনে হয়, এই দফতরের প্রধান একজন মেজর জেনারেলÑ তার চোখেও কি দূর্যোগ-দূর্ঘটনা চোখে পড়ে না? অথচ দ-এ দীর্ঘ ঊ-কার দিয়ে শব্দ আছে সর্বমোট নয়-দশটি। দূর-দূরত্ব (দূর অর্থের সবগুলো), দূত-দূতিয়াল, দূরবীন ( দুরবিনও হতে পারে), দূর্বা, দূষক-দূষণ, দূন, দূরীকরণ বাদে দীর্ঘ ঊ-কার দিয়ে শব্দ পাওয়া ভার। কিন্তু অনেকেই দূর্নীতি, দূর্ভিক্ষ, দূর্যোগ, দূর্ঘটনা, দূর্ভাগ্য, দূর্বোধ্যকে আসলেই দুর্বোধ্য করে তুলছেন। নৌবাহিনীর প্রধান দফতরের সাইনবোর্ডটিতে দূ, নাকি দুÑ তা অনেকেরই বিভ্রান্তির কারণ। লেখার ধরনটাই এমন যে রাতে এক রকমের মনে হয়, দিনে অন্য রকমের। আমাদের অফিসে, হাসপাতালেÑ সর্বত্র নেমপ্লেট-সাইনবোর্ডে ভুল বানান এবং শব্দের অপপ্রয়োগের দশা দেখলে দিশেহারা হওয়া ছাড়া উপায় নেই। মনে হতে পারে, নিজের জানাটাই হয়তো ভুল।
অনেক শিক্ষিত মানুষও (পড়তে হবে, ডিগ্রিধারী) ণত্ব-বিধি মানতে নারাজ। সরকারি দফতরেও এই প্রবণতা আছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক হয়তো বা। কিন্তু তার চেয়ে বেশি হচ্ছে, অজ্ঞতা। রেফ, হসন্ত, বিসর্গ, হস্-চিহ্ন, ঊর্ধ্ব-কমা ব্যবহারে উদাসীনতার চেয়ে না জানার চেষ্টা কিংবা অজ্ঞতাকেই দায়ী করা শ্রেয়। এসব ব্যাপারে বাংলা একাডেমির নির্দেশনা এক-দু’বার দেখে নিলেই হয়। যদিও বাংলা একাডেমির অভিধানই নানা ভুলে ভরপুর; বিশেষত, একেক সংস্করণে একেক রকমের বানানের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য (যেমনÑ দেশি এবং দেশী)। শহরের সাইনবোর্ডগুলোতে চন্দবিন্দুর এক মরণপণ দশা। সিঁড়ি, উঁচু, দাঁত, ফাঁড়ি, রেস্তরাঁ এসবে কোথাও কোথাও চন্দ্রবিন্দু চোখে পড়লেও সেটি কোন অক্ষরের ওপর দেয়া হচ্ছে তা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। মানে চন্দ্রবিন্দুর বারোটা বাজিয়ে সাইনবোর্ডে শোভা পাচ্ছে রেস্তঁরা কিংবা সিড়িঁ।
ইংরেজি এস এবং টি যুক্তাক্ষর হলে তার বাংলা রূপ নিয়ে সহজ সমাধানটি আমরা আজো রপ্ত করিনি। শহরের সাইনবোর্ডে স্টেশন, পোস্ট, রেস্টুরেন্টের বানানে এখনো ‘ষ্ট’ দেখা যায়। বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট আর ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের দু’টি বিশালাকৃতির সাইনবোর্ড একদম পাশাপাশি। এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের কর্তারা অনেক মোটা মোটা বই পড়েছেন, ভাবতেও ভালো লাগে তা। কিন্তু একটিতে ঠিকই ‘ইনষ্টিটিউট’ লেখা হয়েছে। রাজধানীর পুলিশি চেকপোস্টের সবগুলোই চেকপোষ্ট। শুনেছি, কমিশনারের অঙ্গুলি হেলনে তাঁর অধস্তনরা নিমিষেই অনেক কিছু ঘটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ফাড়িও ফাঁড়ি হচ্ছে না, চেকপোষ্টও চেকপোস্ট হচ্ছে না; সময় কোথায় এসবের জন্য। কে যেন বলেছেন, সময় কই, সময় নষ্ট করার? যতিচিহ্নের ব্যবহারেও যুক্তি আর নিয়মের চেয়ে ইচ্ছেতন্ত্র কাজ করছে; সে অবশ্য ভিন্ন এক অধ্যায়।
ড্যাস আর হাইফেনের ব্যবহারেও বিভ্রাট বিস্তর নয়, বরং অন্তহীন। ভালোই, আমাদের কম্পিউটারের কি-বোর্ডে ড্যাস দিতে গেলে আন্ডার স্কোর হয়ে যায়, অতএব ইংরেজিতে ঝামেলা নেই। কিন্তু, বাংলায়! এ দুটোর ব্যবহারে সতর্ক এবং অবহিত না থাকলে একটি বাক্যের অর্থেরই তারতম্য হয়ে যেতে বাধ্য। অন্য দিকে শব্দের প্রয়োগ নিয়ে কত যে বিচিত্র চিত্র তা আর বলার নয়। এর উদাহরণ বিস্তর। সরকারি চিঠির তারিখে ইংরেজি আর বাংলা সাল নির্দেশ করে। কথা হচ্ছে, বাংলা, ইংরেজি কিংবা আরবি সাল বলে কিছু নেই বলেই জ্ঞানীদের দীর্ঘ দিনের ফতোয়া। কোথাও আবার সরণি স্বরনী হয়ে গেছে। একদল আছেন, যারা কর্মসূচি (সূচীতে আপত্তি নেই), শ্রেণি ( শ্রেণীও হতে পারে), দুর্বিপাক, ব্যতীত, দুরন্তকে যথাক্রমে কর্মসুচি-কর্মসুচী, শ্রেনি-শ্রেনী, দূর্বিপাক, ব্যতিত, দূরন্ত লিখে বলবে, বলবেন নাÑ বছর বছর ডিকশনারি চেঞ্জ হচ্ছে। কিন্তু বিশ বছর আগের অভিধানেও সূচির বদলে সুচি, শ্রেণির বদলে শ্রেনি, দুর্বিপাকের বদলে দূর্বিপাক, ব্যতীতের বদলে ব্যতিত, দুরন্তের বদলে দূরন্ত ছিল না। বানানে উদাসীন আর জ্ঞানপাপীরা এভাবেই কুযুক্তি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে অহরহ। এতে ক্ষতি হচ্ছে ছেলেমেয়েদের, যারা কেবল শিখছে এখন।
একজন মাননীয় বলেছেন, সাইনবোর্ডের মিশ্র বানানরীতি ঠিক করা হবে। খুবই ভালো কথা। মন্ত্রীর কথায় আস্থা রাখতেই হবে। আমাদের সাইনবোর্ডগুলোর বানান আর ভাষার যে ছিরি! এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ফ্রেন্ডস ফ্রাই হয়ে আছে। গাড়িতে আবেদিত শব্দটি কে ব্যবহার শুরু করল তা জানতে ইচ্ছে হয়। অনেক নতুন শব্দের ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু অ্যাপ্লাইড ফর রেজিস্ট্রেশনকে কিভাবে আবেদিত বলা হলো বোধগম্য নয়Ñ এ রকম কোনো শব্দই খুঁজে পাওয়া যায় না। বড়জোর আবেদনকৃত বলা যায়, যদিও শ্রেয় হচ্ছে ‘আবেদন করা হয়েছে’ লিখলে। সাইনবোর্ডের মিশ্র ভাষার নিরাকরণ কী করে হবে কঠিন প্রশ্ন। প্রচলিত শব্দের ওপর মাতব্বরি সহজসাধ্য কাজ হবে না। পশ্চিমবঙ্গের সল্টলেকে বড়ই বিসদৃশ লাগে, ‘কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বল’ দেখে। সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের এমন বাংলা অনুবাদ মোটেই সুখপ্রদ নয়, নয় সুখপাঠ্য। কর্মকর্তার বদলে অধিকর্তা, আধিকারক কিংবা একান্ত সচিবের স্থলে আপ্ত-সচিবও ভালো যায় না। অধিদফতরের বদলে নিগমও খুব ভালো লাগবে না।
আমাদের সেক্রেটারিয়েটের প্রতিশব্দ সচিবালয়ই অনেক ভালো, মহাকরণ কারোরই ভালো লাগবে না। একান্ত সচিবকেও আপ্ত-সচিব মানবেন না কোনো মাননীয়। আমরা কেউই কারওর লিখছি না, লিখি কারোর কিংবা কারওÑ দেশ কিংবা আনন্দবাজার গ্রুপের বানানরীতি আমাদের কাজ নয়। আমাদের সাইনবোর্ডের ভুল বানান শুধরে দেয়ার কর্মসূচি সহজ হতে পারে। কিন্তু প্রচলিত এবং বহুল ব্যবহৃত ইংরেজি-আরবি শব্দের অযথা প্রতিশব্দ খোঁজা কঠিনই হবে। তবে যুৎসই প্রতিশব্দে আবার কারো আপত্তি যথাসমীচীন হবে না। যদিও পরিভাষা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে এখনো বিতর্ক আছে।

No comments

Powered by Blogger.