২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি নেই, তদন্তে অনীহা -বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন

বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন তদন্তে চরম অনীহা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ সংক্রান্ত কমিটি করেছে ৫ বছর পর। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় এ সংত্রুান্ত কমিটি করেছে। ইউজিসি তথ্যমতে, দেশে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এখনও ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় কোন কমিটি করতে পারেনি। যারা করছে তাদেরও কোন কার্যত্রুম নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যেক ক্যাম্পাসে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি করতে হাইকোর্টে নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা মানতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বারবার তাগাদা দিয়েও বেশির ভাগ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এই কমিটি করাতে ব্যর্থ হয়েছে। কমিটি করেছে অথচ গত পাঁচ বছরে একটি মিটিং পর্যন্ত করতে পারেনি এমন অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা অন্য কারও যৌন হয়রানির শিকার হয়েও প্রতিষ্ঠান থেকে কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। সমপ্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে তার বিভাগের একজন ছাত্রী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ধরনের কত ঘটনা ঘটেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। গত পাঁচ বছরে ২০টির বেশি ঘটনা ঘটলেও একটি সঠিক বিচার করতে পারেনি ঢাবি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষক কর্তৃৃৃৃক শিক্ষিকাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পর হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। হাইকোর্ট সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন কেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৫ সদস্যের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি করতে বলা হয়। ইউজিসি বলছে, যৌন নিপীড়ন বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে বাববার চিঠিও দিলেও সাড়া দেয়নি বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি করেছে ১৬টি। আংশিক করেছে ৪টি। বাকি ১৪টি এখন পর্যন্ত কোন কমিটি করতে পারেনি। যৌন নিপীড়নের শীর্ষে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই কমিটি গঠন করেনি। কমিটির বিষয়ে ইউজিসি ঢাবি কর্তৃপক্ষকে পাঁচবার চিঠি দিলেও প্রতিষ্ঠানটি এর কোন জবাব দেয়নি। তবে ঢাবি কর্তৃপক্ষ বলছে, চার বছর আগে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন হয়েছে। ঢাবি’র গঠিত কমিটি অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া তো দূরে থাক এখন পর্যন্ত একটি মিটিংও করতে পারেনি। আর এই সময়ের মধ্যে ঢাবিতে ২০টির বেশি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে দেশে বর্তমানে ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪টি এ সংত্রুান্ত কমিটি গঠন করেছে। তারমধ্যে পূর্ণাঙ্গ নিয়ম মেনে করেছে ১৭টি। বাকি ১৭টি কমিটি শর্ত না মেনে দায়সারা কমিটি গঠন করে ইউজিসিতে জমা দিয়েছে। বাকি ৪৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত কমিটি করতে পারেনি। ইউজিসি সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট সেত্রেুটারি (লিগ্যাল) মৌলি আজাদ মানবজমিনকে বলেন, পাবলিক ও প্রাইভেট যারা এ কমিটি গঠন করেছে তারাও নিয়মিত মিটিং করতে ব্যর্থ। কমিটি করেও গত পাঁচ বছরে একটি মিটিংও করতে পারেনি এমন রিপোর্টও আমাদের কাছে আছে। ২০১০ সালে হাইকোর্টের নিদের্শনাযায়ী যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি করে দেয়া দায়িত্ব দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে। কমিটি গঠনের ব্যাপারে রায়ে বলা হয়, ন্যূনতম ৫ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে। কমিটির প্রধান/আহ্বায়ক হবেন একজন নারী। এছাড়া কমিটিতে একাধিক নারী সদস্য থাকবেন। জেন্ডার এবং যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন এমন প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম ২ জন সদস্য এই কমিটিতে থাকতে হবে। কমিটি কোন অভিযোগ পেলে তার তদন্ত করবে এবং অভিযোগ সত্য হলে অভিযুক্তকে আইনের কাছে সোপর্দ করবে। এরপর প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে শাস্ত্তি দিতে আদালতের কাছে সুপারিশ করবে। যৌন নির্যাতনের সংজ্ঞা সম্পর্কে হাইকোর্ট বলেন, শারীরিক ও মানসিক যে কোন ধরনের নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোন বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফির যে কোন ধরনের চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণ সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে। এটি বাস্তবায়ন করতে আইন সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, শিক্ষা সচিব, শ্রম সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ইউজিসি, বিকেএমইএ, বিজিএমইএ, বার কাউন্সিল, পুলিশ, তথ্য মন্ত্রণালয়সহ ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এদিকে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন বন্ধে হাইকোর্টের নীতিমালা তৈরির প্রায় পাঁচ বছর হতে চললেও তা এখনও উপেক্ষিত।
খসড়া আইনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির শিকার হলে অভিযুক্ত ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত আকারে কমিটি বা কেন্দ্রকে জানাবেন। তবে যুক্তিযুক্ত কারণ থাকলে পরবর্তীকালেও অভিযোগ জানানো যাবে। কমিটি তদন্ত করে যদি অভিযোগ মিথ্যা হয়, তাহলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ ব্যক্তি আদালতে আপিল করতে পারবে। এই আইন কেবল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভিক্টিম আলাদা করে আদালতেও মামলা করতে পারবেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখা হবে। এ প্রসঙ্গে  হাইকোর্টে রিটকারী আইনজীবী এডভোকেট ফৌজিয়া করিম বলেন, আমরা শুনেছি কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্বদ্যিালয়ে যৌন হয়রানি রোধের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই তো এখন পর্যন্ত করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাইকোর্টের রায়কে আইন হিসেবে গণ্য করার কথা। রায় ঘোষণার পরের দিন থেকেই তা কার্যকরও করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই তা করা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.