আমাদের আত্মঘাতী গণতন্ত্র! by সোহরাব হাসান

ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে সা ংবাদিক জাহিদুল আহসান একটি সাহসী লেখা লিখেছেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, আমাদের দেশে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়েই লেখালেখি হয়। সেখানে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। প্রত্যেক মানুষেরই অধিকার আছে তাঁর ধর্মীয় মর্যাদা বা পবিত্রতা রক্ষার। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নানাভাবে পীড়িত হচ্ছেন, অধিকার হারাচ্ছেন। অথচ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না। বসে বসে মার খাওয়াই যেন সংখ্যালঘুদের নিয়তি।
একটি বার্তা সংস্থা খবর দিয়েছে, বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী ডিগ্রি কলেজ মাঠে গতকাল পর্যন্ত মন্ত্রী পদে আসীন আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিচারের দাবিতে অনুষ্ঠিত সমাবেশ ও মিছিলে যোগ দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, যুবলীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতারা। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আশরাফ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হজরত আলী মাস্টার, বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জামায়াতের আমির আবদুল হালিম, সেক্রেটারি রবিউল ইসলাম প্রমুখ। দলমত-নির্বিশেষে চৌহালীর নেতারা মনে করেছেন, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন, এর প্রতিবাদে তাঁরা সমাবেশ ও মিছিল করেছেন। সেটি তাঁরা করতেই পারেন। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া কিংবা সরাসরি তাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এ রকম সর্বদলীয় সমাবেশ বা মিছিল হতে আমরা দেখি না।
লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারে বিএনপির নেতারা যে দাবি করেছেন, সরকার নির্দ্বিধায় তা পূরণও করতে যাচ্ছে। এ রকম উদাহরণ যদি আমরা দেশ গঠনে বা বিদেশি নীতিতে দেখাতে পারতাম যে আওয়ামী লীগের যৌক্তিক সিদ্ধান্তের প্রতি বিএনপি সমর্থন জানিয়েছে, আবার বিএনপির যৌক্তিক দাবিও আওয়ামী লীগ মেনে নিয়েছে, তাহলে সেটি হতো সত্যিকার গণতন্ত্র।
গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিরোধী দলেন নেতা সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করেননি। এ নিয়ে দুই নেত্রীর মধ্যকার টেলিসংলাপ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা আমাদের নেতৃত্বের নৈতিক মান পরিমাপের একটা সুযোগ পেয়েছেন। এখন বিএনপির নেত্রী যখন সংলাপে বসার আহ্বান জানাচ্ছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী এক কথায় তা নাকচ করে দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, কাদের সঙ্গে সংলাপে বসব? খুনিদের সঙ্গে, যারা বাস পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছে, যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ মেরেছে?
না, খুনিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে আমরা বসার পরামর্শ দিতে পারি না। যারা এসব খুনখারাবি করেছে, প্রধানমন্ত্রী তো তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। মামলা হয়েছে। বিচার চলছে। কিন্তু বিএনপির যেসব নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে খুনখারাবি, গ্রেনেড হামলা করে মানুষ মারার অভিযোগ নেই, তাঁদের সঙ্গে বসতে আপত্তি কোথায়? যতক্ষণ আইনি-প্রক্রিয়ায় কেউ খুনি প্রমাণিত না হন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে খুনি বলা যায় না।
আলোচনার বিকল্প কী? সংঘাত-সংঘর্ষ, রাস্তায় মারামারি-কাটাকাটি, যার সর্বশেষ মহড়া আমরা ২০১৩ সালে প্রত্যক্ষ করছি। সরকার কি ফের ৫ জানুয়ারির আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চায়। না চাইলে তাকে আজ হোক, কাল হোক আলোচনায় বসতেই হবে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যদি ধ্বংস আর যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন, তাহলে শেখ হাসিনা কেন বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বসতে পারবেন না? বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বসেছিলেন, আপস করতে নয়, জনগণের নেতা হিসেবে জনগণের দাবি আদায় করতে। প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন তিনি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করেছেন, জনগণ তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছে, তাহলে সেই কথাটিই তিনি আলোচনার টেবিলে প্রতিপক্ষের কাছে তুলে ধরতে পারেন। কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে ভারতীয় নেতারা পাকিস্তানের সঙ্গে, ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েলি নেতাদের সঙ্গে বসেছেন, এর অর্থ এই নয় যে তাঁরা তাঁদের দাবি ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের নীতিগত ও আদর্শিক অবস্থান সুদৃঢ় থাকলে সরকারের তো আলোচনায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের গত শাসনামলে বিএনপি যখন সংসদে ছিল কিংবা বিএনপি আমলে যখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল, সংসদে তাদের মধ্যে একধরনের কথাবার্তা হতো। এখন বিএনপি সংসদে নেই, তাই সংসদের বাইরে দেশের ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংলাপ হতে দোষ কী?
বর্তমানে দেশে আন্দোলন নেই, হরতাল-অবরোধের উপদ্রব নেই। তাই ক্ষমতাসীনেরা স্বস্তি বোধ করতে পারেন। কিন্তু এই স্বস্তি কত দিন থাকবে, তা কি তাঁরা নিশ্চিত করে বলতে পারবেন? আওয়ামী লীগের অতি-আত্মবিশ্বাসী মন্ত্রীরা ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, বিএনপির আন্দোলন প্রেস রিলিজ ও ভাষণে সীমাবদ্ধ। সম্ভবত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তাঁদের ভালো লাগছে না। এ কারণে বিএনপির ভাষণ ও প্রেস রিলিজকেন্দ্রিক আন্দোলনকে হরতাল ও বোমাকেন্দ্রিক আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিতে চান!
আমাদের নেতা-নেত্রীরা কথায় কথায় ভারতের উদাহরণ দেন। কেউ কেউ নিজেকে ভারতবন্ধু বলে পরিচয় দিতেও আহ্লাদ বোধ করেন। কিন্তু তাঁরা রাজনৈতিক আচরণে ভারতীয় নেতাদের ঠিক বিপরীত কাজটাই করেন। মাত্র কয়েক মাস হয়েছে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। গত ৫০ বছরে কোনো ক্ষমতাসীন দল এত বেশি এবং বিরোধী দল এত কম আসন পায়নি। কিন্তু নির্বাচনের পর কেউ ‘জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত’ হয়েছে কিংবা ‘আমরাই দেশ শাসনের একমাত্র হকদার’, এই আওয়াজ তোলেননি। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বক্তৃতা-বিবৃতিতে যতটা বেপরোয়া ছিলেন, নির্বাচনের পর ততটাই সংযত। বিজয় মানুষকে যে মহৎ ও উদার করে, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের নেতারা তার প্রমাণ দিলেও আমাদের নেতা–নেত্রীরা উল্টোপথেই চলতে পছন্দ করেন।
৩ অক্টোবর দশেরা উপলক্ষে নয়াদিল্লির সুভাষ ময়দানে আয়োজিত সমাবেশের চিত্রটি দেখুন। হিন্দু ধর্মমতে রাবণের বধ হলো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির বিজয়। নয় দিন যুদ্ধের পর দশম দিনে এই বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়েছে বলে তাঁরা এটিকে দশেরা বা বিজয়া দশমী হিসেবে পালন করেন। বাঙালি হিন্দুর কাছে যা বিজয়া দশমী, উত্তর ভারতের হিন্দুদের কাছে তা-ই দশেরা। এই দশেরা উপলক্ষে সুভাষ ময়দানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে যে বিরাট সমাবেশ হয়েছিল, তাতে একই মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী প্রমুখ। মঞ্চে পাশাপাশি বসে তাঁরা বক্তব্যও দেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তাঁর বক্তৃতায় দশেরার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বললেন, অপশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির এই বিজয় আমাদের সমস্যার সমাধান এবং দেশের উন্নয়নে একত্রে কাজ করার প্রেরণা দেবে।
বাংলাদেশে এর বিপরীত চিত্রটি লক্ষ করুন। ঈদ উপলক্ষে আমাদের নেতা-নেত্রীরা শান্তির ললিত বাণী শোনালেও কখনোই তাঁরা একসঙ্গে বসেন না, কথা বলেন না। ঈদে দুই নেত্রীর ঈদকার্ড বিনিময়ই একমাত্র শুভেচ্ছার প্রতীক হয়ে থাকে। এবং সেটাই পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবরও হয়।
প্রতিবারই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ঈদ উপলক্ষে যে সাড়ম্বর সংবর্ধনার আয়োজন করেন, তাতে একমাত্র অভিন্ন আমন্ত্রিত হলেন বিদেশি কূটনীতিকেরা। আর সবাই বিভক্ত। সংবর্ধনা সভায় দুই নেত্রী যে বক্তৃতা দেন, তার ভাষাভঙ্গিও কম আক্রমণাত্মক নয়। একজন যদি সর্বত্র শান্তি দেখেন অন্যজন দেখেন অশান্তি, একজন যদি সমৃদ্ধির সন্ধান পান, অন্যজন অভাব ছাড়া কিছু দেখেন না। ঈদের মতো, পূজার মতো নিছক ধর্মীয় আয়োজনেও তাঁরা রাজনীতি খোঁজেন। তাঁরা ভুলে যান যে রাজনীতির বাইরেও মানুষের জীবন আছে। সংস্কৃতি আছে। স্বপ্ন আছে। ভালোবাসা আছে।
আমাদের নেতা-নেত্রীরা একবার নির্বাচনে জেতার পর কোনো দিন হেরেছিলেন বা ভবিষ্যতে হারতে পারেন, সে কথাটি মনে রাখেন না। একেকটি নির্বাচনের পর আমাদের নেতারা একেকটি হিংসা আর বিদ্বেষের সৌধ নির্মাণ করেন, যার নিচে চাপা পড়ে থাকে বহু মানুষের জীবন, রক্ত আর দীর্ঘশ্বাস। এটি যে কেবল ২০০৮ ও ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিজয়ী দলের জন্যই প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী দলের বেলায়ও।
ভারত যে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠতে পেরেছে, এত উন্নতি করতে পেরেছে, তার পেছনে আছে জাতীয় ঐকমত্য। বিদেশনীতিসহ সব জাতীয় ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা হয়। বিতর্ক হয়। কিন্তু আমাদের নেতা-নেত্রীরা বিতর্ক জিনিসটি একদমই পছন্দ করেন না। তাঁরা কেউ কাউকে সম্মান করে কথা বলেন না। বরং একে অপরকে নিয়ত নিন্দা করে আনন্দ পান। তাঁরা সবাই মিলে দেশ গড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে উদগ্রীব থাকেন।
এটাই হলো আমাদের আত্মঘাতী গণতন্ত্রের সঙ্গে ভারত বা অন্যান্য দেশের জনকল্যাণমুখী গণতন্ত্রের আসমান–জমিন ফারাক।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.