মতিন ভাই আপনাকেও ভুলে যাবো by আবদুর রহিম

মতিন ভাই, আজ নিজেকে বড় অসহায় মনে করছি। অবশেষে আমাদের শেষ আশার স্থলটিও শূন্য হয়ে গেল প্রাকৃতিক নিয়মে আপনার তিরোধানের পর। আপনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। নিজের জীবনে কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা করেননি কখনো। অর্থবিত্ত, সামাজিক বা রাজনৈতিক পদ বা পদবির মোহ কখনো পারেনি আপনাকে আদর্শচ্যুত করতে। যা ন্যায্য মনে করেছেন তার জন্য অকুতোভয়ে কাজ করেছেন। নিরীহ, নির্র্যাতিত মানুষের পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্রাবস্থায় থেকে। নিগৃহীত হয়েছেন তার জন্য। এমন নির্ভীক মানুষ খুব কমই জন্মেছে আমাদের দেশে। যারা এ গুণ নিয়ে জন্মেছেন তাদের আমরা দেইনি যথাযোগ্য সম্মান। মহৎ ব্যক্তিরা সম্মানের কাঙাল হন না। আপনি তো আজ সব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। না, সব মানুষ ভুললেও অন্তত দু’জন মানুষ আমরণ স্মরণ রাখবে আপনাকে । আপনার দান করা চক্ষু দিয়ে তারা দেখবে সুন্দর পৃথিবীর কদর্য রূপ। পারবে কি তারা আপনার আদর্শ অনুকরণ করে সংগ্রামী মানুষের অধিকার সংরক্ষণের জন্য যুদ্ধ করতে?
ফজলুল হক হলের টেনিস কোর্টে পাবনার এক বিত্তশালী পরিবারের সার্থক খেলোয়াড় মতিন ভাইয়ের কাছে সে আমলের ক্রেজ সিএসপি হওয়া মোটেই কষ্টসাধ্য ছিল না। পঞ্চাশ দশকের কথা। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মি. জিন্নœাহর রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক বক্তব্য সবেমাত্র ছাত্রসমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল, তবে তখনো তা দানা বেঁধে ওঠেনি। টগবগে যুবক মতিন ভাই যখন তখন তার ঝকঝকে রেলি সাইকেলে বেরিয়ে পড়তেন বিভিন্ন কলেজ-স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বীজ ছড়িয়ে দিতে। রাষ্ট্রভাষা আন্দেলনের আর এক অন্যতম প্রবক্তা মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন ঢাকার ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুুলের শিক্ষক ও মতিন ভাইয়ের অনতম সহযোগী। বর্তমান বুয়েটের পূর্ব দিকে ছিল সুলতান ভাইয়ের ছোট একটি বইয়ের দোকান, নাম পুঁথিঘর। ওখানে মিলিত হতেন প্রগতিশীল লেখক ও সমমনা লোকেরা। এক কথায় পুঁথিঘরকে বলা যায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। প্রখ্যাত প্রগতিশীল কবি হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন সুলতান ভাইয়ের ঘনিষ্ঠজন। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ও সুলতান ভাইয়ের প্রকাশনায় প্রকাশ পায় একুশের ওপর এক অসাধারণ সঙ্কলন। পাকিস্তান সরকার পরে এ সঙ্কলন প্রকাশ ও প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও হাসান হাফিজের ভাগ্যে জোটেনি একুশে পদক। এ নিয়ে সমালোচনা হওয়ার পর হাসান হাফিজের ভাগ্যে অগত্যা জোটে মরণোত্তর একুশে পদক। অথচ এই মহান মানুষটি স্বাধীনতাযুদ্ধের ২০ খণ্ড পুস্তকের  সম্পাদক। তার মৃত্যুর পর এম আর মুকুলকে প্রকাশনার দায়িত্ব দেয়া হয়; কিন্তু পুঁথিঘরের প্রতিষ্ঠাতা ও একুশে সঙ্কলনের প্রকাশক রয়ে যান অবহেলিত। স্বাধীনতার পর  মোহাম্মদ সুলতানকে একুশে পদক দেয়ার প্রস্তাব হয় পিআইডির পক্ষ থেকে; কিন্তু সে প্রস্তাব সদাশয় সরকারের অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হয়। প্রগতিশীল লেখকদের সার্থক প্রচেষ্টা সে সময় তরুণ-যুবকদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে। আবু জাফর ওবাইদুল্লার কবিতা ‘কুমড়ো ফুলে ফলে নুয়ে পড়েছে লতাটা। খোকা তুই কবে আসবি, কবে ছুটি’ সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে আবৃত্তি হতো।
আমরা এক আত্মভোলা জাতি। অতীতকে অতি সহজে ভুলে যাই। হ্যাঁ, মতিন ভাই আপনাকে ভুলতে আমাদের  সময় বেশি দিন লাগবে না। মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, জেনারেল ওসমানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও  তাজউদ্দীনকে কি আমরা যথার্থ মর্যাদা দিয়েছি? রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইতিহাস লেখা হয় নবরূপে। তাই মনে হয় আপনি কিছু দিন সংবাদমাধ্যমে বেঁচে থাকবেন, পরে আমরা যথারীতি আপনাকে ভুলে যাবো। আপনার সক্রিয় সহযোগী, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদ ও মোহাম্মদ তোয়াহা কালের অতলে ডুবে গেছেন। একটা প্রবাদ আছে যে জাতি বীরদের সম্মান করতে জানে না সে দেশে বীরের জন্ম হয় না। মতিন ভাই বৃহস্পতিবার শহীদ মিনারে গিয়ে দারুণভাবে হতাশ হয়েছি। ভেবেছিলাম লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে আপনার সাধের শহীদ মিনার প্রান্তরে, এত কম লোক সমাগম দেখে মনে হলো ঢাকায় সম্ভবত লোক সমাগম নিদারুণভাবে কমে গেছে। হয়তো বা অতিরিক্ত গোশত ভক্ষণের ফলে অনেকে বাড়িতে বসে টিভিতে দেখছেন মতিন ভাইয়ের শেষ যাত্রা। সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে দেখা এক পরিচিতজন জানতে চাইলেন আমি শহীদ মিনারে গেছি কি না, হ্যাঁবোধক উত্তর দিয়ে প্রশ্নকর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোন দিকে ছিলেন, গর্বভরে ব্যবসায়ী বন্ধুর উত্তর, না আমি ওখানে যাইনি, আপনাকে টিভিতে দেখেছি। টিভিতে মতিন ভাইয়ের শেষ অনুষ্ঠান দেখার জন্য ‘মহান’ এই ব্যবসায়ীকে জানালাম অভিনন্দন। বহুত কিসিমের ব্যবসাবাণিজ্যের সাথে ব্যবসায়ীর সম্পর্ক বিশ্বব্যাপী। সেনাশাসিত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ব্যবসায়ী বন্ধুকে একটু মুসিবতে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু সঠিক জায়গায় কানেকশন থাকলে সব আজাব থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হয়। তবে সে জন্য প্রয়োজন যৎসামান্য দানদক্ষিণার। কোনো কারণে কাশিম বাজার কুঠিতে যেতে হলেও এ ধরনের রাঘববোয়লরা পান ফাইভস্টার
হোটেলের সেবা-শুশ্রƒষা। অর্থবিত্ত কী না করতে পারে?
বেয়াদপ মিডিয়ার কারণে মানুষ অনেক সময় জানতে পায় উজির নাজিরদের নানা রকম অনিয়মের খবর। তা নিয়ে চলে কিছু দিন নানা আলোচনা-সমালোচনা, টিভি ও টকশোতে চলে জোরালো আলোচনা-সমালোচনা । অনিয়ম তদন্তের জন্য গঠিত হয় উচ্চপার্যায়ের কমিটি, সময় নির্ধারিত করে দেয়া হয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের জন্য। তবে নির্ধারিত সময়ে কোনো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়ার ইতিহাস খুঁজে পেতে হলে তার জন্য প্রয়োজন অতি শক্তিশালী অন্য একটি কমিটি নিয়োগের; কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল ও সময়ের অভাবে তা সম্ভব হয় না।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞ। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক অজানা মুক্তিযোদ্ধা নানা কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। অথচ এই হতভাগ্যদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা চরম অন্যায়ভাবে দখল করে বেশ কিছু আমলা-কামলা মহাসুখে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থেকে ‘দেশ-সেবা’ করে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কি নেয়া যায় না? অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে অন্যায় বাড়তে থাকে বহু গুণে। মতিন ভাই সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এসব কথা কারো কারো কাছে অবান্তর মনে হতে পারে; কিন্তু মতিন ভাই সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন।
বর্তমানে খবরের শিরোনামে আসছে বহু দায়মুক্তির সংবাদ। উজির-নাজিরদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে অর্জিত অর্থসম্পদ অর্জনের অপরাধ তদন্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। আল্লাহর রহমতে এখন অভিযুক্তরা দায়মুক্তি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। বিরাট ওজনের এসব ব্যক্তির শাস্তি দেয়া অত সহজ নয়।
ক্ষমতাধরদের সাগরেদরা এক এক এলাকার ত্রাস হিসাবে চিহ্নিত বলে তাদের আবদার তো ফেলা যায় না। বারিধারার পশ্চিম দিকে কোরবানির পশুর হাটের ইজারাদের এক মাস্তান মানুষের বাড়ি দখল-বাণিজ্যে নিয়োজিত। তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হলেও, পুলিশ তার কাছে যেতে পারেনি। দুঃখের কথা আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং অভিযোগ করেছেন, তার লিখিত নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ঢাকা-উত্তরের প্রশাসক হাসপাতালের পাশে, পশুর বাজার বসার অনুমতি দেন। মন্ত্রী এ প্রশাসকের অপসারণ দাবি করেছেন সংবাদমাধ্যমে । ‘আমি তো মন্ত্রী মহোদয়ের লিখিত নির্দেশ দেখিনি’, ওই প্রশাসক জানান সংবাদমাধ্যমকে । তা হলে দেশ চলছে কার নির্দেশে বা কী নিয়মে?
মোনায়েম খাঁর আমলের একটা ঘটনার উল্লেখ করে আজকের লেখা শেষ করছি। সিলেটের আবদুল বাছেত সাহেব ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদ নেতা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তাকে তখন বেশ ক্ষমতাধর ব্যক্তি বলে গণ্য করা হতো । মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যক্তিগত কাজ নির্ধারিত সময়ে সমাধা না করায় তিনি তার অন্যতম এক পিয়নকে রেগে-মেগে বললেন, আজ আমি তোমায় বরখাস্ত করব। নির্লিপ্ত পিয়নের জবাব: তা সম্ভব নয়, আমি কেবিনেট ডিভিশনের পিয়ন, ওখানে আবার ফিরে যাবো। মন্ত্রী মহোদয় উপস্থিত উমেদার ও অফিসারদের দিকে কেলায়িত মুখে চেয়ে রইলেন। দিন বদলায়, পতাকা বদলায় কিন্তু প্রচলিত রীতিনীতি তেমন বদলায় না।
লেখক : বাংলাদেশ অবজারভারের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক
envoy@btcl.net.bd

No comments

Powered by Blogger.