উভয় সংকটে জাপা by শাহেদ চৌধুরী/রাজীব আহাম্মদ

সরকারে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জাতীয় পার্টি উভয় সংকটে। আজ দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে পারেন। এর পর বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পার্টিকে সরকার এ পর্যায়ে কোনোভাবেই চটাতে চায় না। তারা মন্ত্রিসভায় আসতে চাইলে স্বাগত জানানো হবে। তবে তাদের চারটির বেশি মন্ত্রিত্ব না দেওয়ার পক্ষে আওয়ামী লীগ। সরকারে অংশ না নিয়ে যদি নির্ভেজাল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে চায় জাপা, সেক্ষেত্রেও সরকারের কোনো আপত্তি থাকবে না; বরং আওয়ামী লীগের সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতা জাপাকে কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে দেখতে চান। সরকারের শীর্ষ একটি সূত্র গত রাতে সমকালকে জানান, জাপা মন্ত্রিসভায় অংশ নিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এবার তিনি ঐকমত্যের সরকার গঠন করবেন। তবে সেখানে সব দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে কি-না, তা স্পষ্ট করেননি। এদিকে কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমে
খবর প্রকাশ করা হচ্ছে যে, জাপা সরকারে অংশ নিচ্ছে। এজন্য সম্ভাব্য এ সরকারকে এক অভিনব বা অদ্ভুত সরকার হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাপা প্রকৃতপক্ষে সরকারে অংশ নিচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়। বিষয়টি আজ স্পষ্ট হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জাপার চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ অনেকেই নির্ভেজাল বিরোধী দল হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের পক্ষে। তারা সরকারে অংশ নিতে চান না। তবে জাপার বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা সরকারের মন্ত্রিসভায় অংশ নিতে চান। পাশাপাশি বিরোধী দলের দায়িত্বও পালন করতে চান। আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করছে, জাপা বিরোধী দলে থেকে সরকারের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করুক। এতে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে। বিএনপির অনুপস্থিতি জাপা পূরণ করুক।
বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নেতারা সমকালকে জানান, দলের কয়েক নেতা মন্ত্রী হতে মরিয়া হলেও সরকারে অংশ নিতে চায় না জাতীয় পার্টি। মাত্র দুই মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে সরকারে যোগ দেওয়ার চেয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে আগ্রহী তারা। দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শপথের পর জাপার অবস্থান আজ পরিষ্কার করা হবে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩৩ আসন পেয়ে সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় পার্টি। সরকারে যোগ না দিলে জাতীয় পার্টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অন্তত সাত-আটটির সভাপতির পদ নিতে পারে বলে জানা গেছে।
রওশনের অতিঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দলটির এমপি মসিউর রহমান রাঙ্গা সমকালকে বলেন, 'গৃহপালিত' নয়, 'নির্ভেজাল' ও শক্ত ভাবমূর্তির বিরোধীদলীয় নেতা হতে চান রওশন। সরকারের ইচ্ছায় নির্বাচনে অংশ নিলেও সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে চান তিনি।
সূত্র জানায়, বিরোধী দলে থাকার শর্তে 'একতরফা' নির্বাচন মেনে নিতে রাজি এরশাদ। মনোনয়নপত্র দাখিল করেও গত ৩ ডিসেম্বর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। তার নির্দেশে দলের একাংশ নির্বাচন বর্জন করে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। অপরাংশ রওশনের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেন। এরশাদ নিজেও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করলেও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে 'অন্তরীণ' অবস্থায় রংপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হন।
নির্বাচিত হলেও এরশাদ এখনও শপথ নেননি। আজ তিনি শপথ নিতে পারেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য তাজুল ইসলাম। কুড়িগ্রাম-২ আসনের নবনির্বাচিত এ এমপি জানান, এরশাদ সরকারে অংশ নিতে চান না। এরশাদের চাওয়া, বিরোধী দলের আসনে বসুক জাতীয় পার্টি। তাজুল ইসলাম বলেন, 'এরশাদ আমাদের নেতা। তার চাওয়া পূরণ করে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হবে। সরকারে যাবে না।'
সরকারে যোগ না দেওয়ার কারণ সম্পর্কে মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, 'সংসদে বিরোধী দলে বসে মন্ত্রিত্ব করা যায় না। তাহলে সরকারেরই অংশ হয়ে যেতে হয়।'
সূত্র জানায়, দলীয় চার এমপি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন বাবলু ও মুজিবুল হক চুন্নু বিরোধী দলের আসনে বসে সরকারে যোগ দিতে চান। দলের অন্য এমপিদের বেশিরভাগ সরকারে যেতে চান না। তারা 'একতরফা' নির্বাচনে এমপি হয়ে খোয়ানো সম্মান বিরোধী দলের আসনে বসে পুনরুদ্ধার করতে চান। রওশনের ঘনিষ্ঠ যেসব নেতার মন্ত্রী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তারাও সরকারে যোগ দেওয়ার ঘোর বিরোধী। দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার দু'পক্ষের সঙ্গেই আছেন বলে জানা যায়।
গত বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন রওশন। সেখানে সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা হয়। তবে কোনো পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পরদিন 'ঐকমত্যের সরকার' গঠনের কথা বলেন। তবে সরকারে কোন কোন দল থাকবে, তা স্পষ্ট করেননি। জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ থাকবে কি-না সে বিষয়েও কোনো কিছু বলেননি। তবে আওয়ামী লীগের তিন উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন, জাপাকে যেন বিরোধী দলে রাখা হয়। তাদের মত হলো, সংসদে একটি বিরোধী দল থাকুক। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের উপস্থিতি না থাকলে সরকারের জন্য তা বিব্রতকর হয়। জাতীয় পার্টি 'বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা' করলে তা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য সহায়ক হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে একটি কার্যকর সংসদ উপস্থাপন করা যাবে। জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গে একাকার হয়ে গেলে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির গায়েই বিরোধী দলের তকমা থাকবে। বিরোধী দলের 'লেবেল' জাতীয় পার্টির গায়ে লাগিয়ে দিলে নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি সাধারণ মানুষের কাছেও বিরোধী দলের মর্যাদা হারাতে থাকবে।
আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে রাখার পক্ষে ইঙ্গিত দেন। প্রবীণ এ নেতা বলেন, 'গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ভিজিলেন্স (সতর্ক পাহারা) অপরিহার্য। যে গণতন্ত্রে ভিজিলেন্স নেই, তা অটোক্রেসির (স্বৈরতন্ত্রে) রূপ নেয়। যে কোনো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দল সে দায়িত্ব ?পালন করে।' সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে জাতীয় পার্টির বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'আমাদের সবারই যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে। ঐকমত্যের সরকারের নামে আমরা যেন কাঁঠালের আমসত্ত্ব না বানাই।'
১৯৯৬ সালের সংসদে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির দুই এমপি হাসিবুর রহমান স্বপন ও আলাউদ্দিন আহমেদ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিত্ব নেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ফ্লোর ক্রসিংয়ের কারণে তাদের সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়। মসিউর রহমান রাঙ্গা এ উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'নজির তো সামনেই আছে। যারা মন্ত্রিত্বের লোভে লালায়িত হয়ে সরকারে যেতে চান তাদের এ পরিণতি হতে পারে।'
এদিকে গতকাল রাতে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা। এ সময় নতুন মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে তাকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আগামীকাল রোববার সকাল ৮টায় গণভবনে আসার কথা বলেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী ওই সময়ে মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের নামের তালিকা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের হাতে তুলে দেবেন। পরে নতুন মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানাবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

No comments

Powered by Blogger.