ঘুরে দাঁড়াতে চায় বিএনপি by লোটন একরাম ও রেজা মাহমুদ

দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে 'রাজনৈতিক বিপর্যয়' কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। নির্বাচন বর্জন করে লাগাতার হরতাল-অবরোধ দিয়েও প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এ ব্যর্থতার নেপথ্যে 'কারণ' বা 'ভুলগুলো' চিহ্নিত করে তা সংশোধনের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছাতে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে দলের হাইকমান্ড। ১৯ জানুয়ারি দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে 'ঘুরে দাঁড়াতে' চায় দলটির হাইকমান্ড। দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীতে একটি সমাবেশ থেকে নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করাই হবে বিএনপির নতুন রূপরেখার মূল লক্ষ্য। তবে এখন পর্যন্ত দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করতে পারছেন না খালেদা জিয়া। এ পরিস্থিতিতে টেলিফোনেই নতুন পরিকল্পনা নিয়ে নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। দলের নীতিনির্ধারক নেতারা বলছেন, দেশি-বিদেশি সব মহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ পরিস্থিতিতে তারা এ সরকারকে বেশি দিন সময় দিতে চান না। দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারকে বিদায় করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যা যা করা দরকার, তা করবেন তারা। তারা আশা করছেন, দেশি-বিদেশি চতুর্মুখী চাপে সরকার দ্রুত বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে। অবশ্য খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় বলেছেন, 'যদি কিছু বলার থাকে, আলোচনায় আসুন। সহিংসতা ও নৈরাজ্য বন্ধ করুন। নইলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
সূত্র জানায়, বিএনপির নতুন পরিকল্পনার মধ্যে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে ঢেলে সাজানো, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ভিত্তিক টিম গঠন, দলকে জিয়াউর রহমানের আদর্শে ফিরিয়ে আনা, নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে বিভিন্ন দল ও মতের মানুষকে নিয়ে বৃহৎ জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন কাজে লাগানো এবং আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো ইত্যাদি। এরই মধ্যে লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দলকে বিপর্যয় থেকে টেনে তুলতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতে লাগাতার হরতাল-অবরোধে বিএনপির বিপুলসংখ্যক কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী এখন কারারুদ্ধ। গ্রেফতার আতঙ্কে আত্মগোপনে রয়েছেন বাকিরা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি দিলেও গ্রেফতার ও পুলিশি নির্যাতনের ভয়ে রাজধানীতে রাজপথে নামেননি নেতাকর্মীরা। বিপুলসংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা বেষ্টিত হয়ে বেশ কয়েক দিন
'অবরুদ্ধ' থাকার পরও প্রকাশ্যে আসতে পারেননি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ অবস্থায় নতুন করে আবার আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান গতকাল সমকালকে বলেছেন, সরকারকে একতরফা ও প্রহসনের নির্বাচন বাতিলে বাধ্য করতে চলমান আন্দোলন চলবে। তবে নতুন করে আরও কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন তারা। আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো, আন্তর্জাতিক লবিং জোরদার এবং আন্দোলনকে চাঙ্গা করার ব্যাপারে কাজ করবেন তারা। তারা আশা করেন, গণআন্দোলনের মুখে সরকার আলোচনায় বসতে রাজি হবে।
সাংগঠনিক দুর্বলতা নিরসন :সূত্র জানায়, লাগাতার অবরোধ দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করতে পারবে বলে আশা করেছিল বিএনপির হাইকমান্ড। দলটির দাবির প্রতি দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের সমর্থন থাকার পরও শুধু দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি বলে বুঝতে পেরেছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, পর্যায়ক্রমে দলের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোতে নতুন কমিটি গঠন ও নিষ্ক্রিয় কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হবে। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কাজগুলোকে একাধিক নেতার মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হবে; গঠন করা হবে বিষয়ভিত্তিক টিম। ওই সব কমিটিতে রাখা হবে দল সমর্থিত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নেতাদেরও।
সূত্র জানায়, বিএনপির অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী মনে করেন, বর্তমানে দলটির জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও ১৯ দফা কর্মসূচির রাজনীতি থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে। ১৯ জানুয়ারি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানগুলোতে তার আদর্শে দলকে ফিরে এসে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হবে। পুলিশ অনুমতি দিলে এ উপলক্ষে রাজধানীতে একটি সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। ওই সমাবেশ করতে পারলে সেখান থেকে নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করবেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
বৃহৎ জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা :নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বৃহৎ জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিচ্ছে বিএনপি। দশম সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে অংশ নিয়েছে ১২টি দল। বিএনপি বাকি ২৮টি দলকে নিয়ে একটি বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে চায়।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না হওয়ায় ২৮টি রাজনৈতিক দল তা বর্জন করেছে। নির্বাচনের আগে এসব দলকে নিয়ে বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে না পারা তাদের ব্যর্থতা। এখন এসব দলকে এক মঞ্চে এনে আন্দোলন করলে তা আরও বেশি তৎপর হবে বলে মনে করেন তারা। এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে নতুন করে হিসাব-নিকাশও করতে পারে বিএনপি হাইকমান্ড। বিশেষ করে জঙ্গিবাদ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগে বিএনপির ওপর দেশি-বিদেশি চাপের বিষয়টি নিয়েও চিন্তিত তারা। এরই মধ্যে ওয়াশিংটন টাইমস ও ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে পৃথক সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট স্থায়ী নয়। সাময়িক এ জোটকে কৌশলগত অবস্থান হিসেবে জানিয়েছেন তিনি।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের বাইরে থাকা দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে শিগগির বিএনপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হবে। ওই সব দলের মনোভাব জানতে চাইবে বিএনপি। তাদের মতামত নিয়ে দলের সর্বোচ্চ স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে বৃহৎ ঐক্য গড়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বিকল্পধারা, গণফোরাম, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), সিপিবি ও বাসদ প্রভৃতি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন কাজে লাগানো :বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের বর্জনের মুখে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে হতাশা ব্যক্ত করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। নির্বাচনের পর জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, চীনসহ অনেকে বিবৃতি দিয়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত ও সহিংসতা বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দ্রুত সংলাপে বসতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।
বিএনপির কয়েকজন নেতা সমকালকে জানান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের 'একতরফা' নির্বাচন গ্রহণ করেনি। এ পরিস্থিতিতে বিদেশিদের এ অবস্থানকে কাজে লাগাতে চায় তারা। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন খালেদা জিয়া। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে খালেদা জিয়া নিজেও বৈঠক করে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম এবং বিএনপিসহ ২৮টি রাজনৈতিক দলের বর্জনের বিষয়টি তুলে ধরেন।
জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে নতুন কর্মসূচি :টানা অবরোধে নেতাকর্মী ও জনগণের অংশগ্রহণ না থাকায় নতুন কর্মসূচির পরিকল্পনাও করছে বিএনপি। দীর্ঘদিন চলা অবরোধ একঘেয়ে ও জনদুর্ভোগের কারণ হওয়ায় জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির দিকে যেতে চাইছে দলটি। এ জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশব্যাপী রোডমার্চের কথা ভাবা হচ্ছে বলে দলীয় নেতারা জানান। এতে সরকারের একতরফা নির্বাচন এবং বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরবেন তিনি। একই সঙ্গে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে দেশব্যাপী ব্যাপক তৎপরতাও চালাবে দলটি। নানা হিসাব-নিকাশ কষে গতকাল শুক্রবার ও আজ শনিবার দু'দিন অবরোধ স্থগিত রেখেছে বিরোধী জোট। আজ ১৮ দলীয় জোটের দেশব্যাপী বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচি রয়েছে। রোববার থেকে আবার টানা অবরোধের কর্মসূচি রয়েছে। এ ধরনের রাজপথের কর্মসূচি দিয়েই আন্দোলন নতুন করে গতিশীল করতে চাইছে ১৮ দল। রাজপথে নামতে বাধা দিলে প্রতিবাদে হরতাল দেবে জোট। এভাবে একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে রাজপথের আন্দোলন 'গতিশীল' করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিরোধী জোট।

No comments

Powered by Blogger.