ভয়ঙ্কর জালিয়াত চক্র by রাশেদ মেহেদী/সাহাদাত হোসেন পরশ

বাংলাদেশে আস্তানা গেড়েছিল তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ভয়াবহ আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র। এই শক্তিশালী চক্রটি ঢাকার উত্তরার ১২নং সেক্টরের সেই বাড়িতে বসেই চীন, তাইওয়ানসহ এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ক্রেডিট কার্ড ও অনলাইন অ্যাকাউন্ট জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছিল। র‌্যাবের তদন্তে শুধু তাইওয়ান ও চীনের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমেই বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ খাতে এ ধরনের প্রতারক চক্রের সন্ধান গোটা দুনিয়াতেই এই প্রথম বলেও তদন্তের দায়িত্বে থাকা র‌্যাব সূত্রের দাবি। ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিং আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে ঢাকাকে ব্যবহার করার কারণ হিসেবে বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত দুর্বল নিরাপত্তার অনলাইন ব্যবস্থা ব্যবহারের তথ্য দিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। বিদায়ী বছরের শেষ সপ্তাহে গত ২২ ডিসেম্বর উত্তরার ১২নং সেক্টরের একটি বাসা থেকে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় অবৈধ আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন কেন্দ্র আবিষ্কার করে র‌্যাব। ৩৭ জন বিদেশি কর্মকর্তা আটকসহ এখান থেকে একসঙ্গে ৮৮টি গেটওয়ে উদ্ধার করা হয়, যা এখান থেকে বিপুল পরিসরে অবৈধ টেলিযোগাযোগ ব্যবসার প্রমাণ দেয়। তখনই গোয়েন্দাদের সন্দেহ হয়, এখানে অন্য কোনো বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছিল। এর সূত্র ধরেই মিলে যায় ব্যাংকিং খাতের আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সন্ধান। গ্রেফতারের পরপর সুচতুর বিদেশি নাগরিকরা নিজেদের ইংরেজিতে দুর্বল এবং কম শিক্ষাগত যোগ্যতার দাবি করলেও জিজ্ঞাসাবাদে চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে। গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ডিগ্রিধারী।
র‌্যাবের তদন্ত দল নিবিড় তদন্তের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বড় ধরনের অপরাধের বিষয়টি উদ্ঘাটনে সক্ষম হলেও তথ্য যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি কোনো সহায়তা দিতে পারেনি। প্রতারক চক্রের উত্তরার ওই কেন্দ্রে নিজস্ব গেটওয়ে ব্যবহার এবং এসটিএম-৪ ব্যবহার করে উচ্চ ক্ষমতার ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও বিটিআরসি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি পিএসটিএন লাইনটি কোন কোম্পানির ছিল এবং এসটিএম-৪-এর মতো উচ্চপ্রযুক্তি সহায়তা কীভাবে এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসটিএম-৪ বাংলাদেশে বিটিসিএলসহ আইজিডবি্লউ প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করলেও অবৈধ কল টার্মিনেশনের জন্য এর আগে এ প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যায়নি। উত্তরার ওই বাসা থেকে বিকল্প যোগাযোগের জন্য ভি-স্যাটও উদ্ধার করা হয়। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিটিআরসির কাছে সহায়তা চাইলে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চ ডিগ্রিধারী একজন কর্মকর্তাকে পাঠান, টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কে যার ধারণা এবং জানার পরিধি যথেষ্ট নয়। এ কারণে র‌্যাব বাধ্য হয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিচ্ছে। আটক বিদেশিরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের নানা অংশীদার সম্পর্কে মুখ খুললেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের অংশীদার সম্পর্কে কোনো তথ্য দিচ্ছে না। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আইপি টেলিফোনির লাইসেন্স রয়েছে এমন কোনো আইএসপি প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। প্রাথমিকভাবে বিদেশি চক্রের বাংলাদেশি অংশীদারদের একটি গ্রুপ শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তারা এ মুহূর্তে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে বলে সূত্র জানায়।
র‌্যাবের তদন্তে যা উঠে এসেছে : মামলাটির তদন্তের সঙ্গে যুক্ত র‌্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে জানান, চীন ও তাইওয়ানের ৩৭ নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বসেই ভিওআইপির ব্যবসার আড়ালে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতিসহ ব্যাংকিং খাতের অনেক প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রতারণার জন্য 'নিরাপদ' স্থান বিবেচনা করে তারা বছর দেড়েক আগে থেকে বাংলাদেশে আস্তানা গাড়ে। চীন ও তাইওয়ানভিত্তিক ব্যাংকিং খাতের নানা জালিয়াতি ছিল তাদের প্রধান কাজ। ওই দুই দেশের অনেক নাগরিককে ইতিমধ্যে এ চক্রটি নিঃস্ব করেছে। ওরা ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসেছিল।
র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, এর আগে একাধিক দফায় বাংলাদেশভিত্তিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্রের সন্ধান পাওয়া গেলেও এবারই প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্রের সন্ধান মিলল। তবে এই চক্রটি বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাইওয়ান ও চীনের ৩৭ নাগরিকের সঙ্গে বিদেশি আরও একটি গ্রুপ এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। উত্তরার বাসা থেকে এ চক্রটির গ্রেফতারের খবর জানাজানি হওয়ার পরপরই তারা গা-ঢাকা দিয়েছে।
জানা গেছে, জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত এ প্রতারক চক্রের অধিকাংশ সদস্যই প্রকৌশলী। বিদেশি এ প্রতারক চক্রের সহায়তাকারী হিসেবে বাংলাদেশের একটি গ্রুপকে শনাক্ত করা হয়। ইতিমধ্যে তারা গা-ঢাকা দিয়েছে। বিদেশি জালিয়াত চক্রের সহায়তাকারীদের গ্রেফতারে ইতিমধ্যে অনেক জায়গায় অভিযান চালানো হয়। গ্রেফতার হওয়া অধিকাংশ বিদেশি ইংরেজি বলতে পারদর্শী না হওয়ায় তদন্তে ব্যাঘাত হচ্ছে।
উত্তরা থেকে গ্রেফতার ৩৭ বিদেশিসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় দুটি মামলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪৩ জনের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিক মোজাম্মেল হোসেন রাশেদকে একদিন এবং বাকিদের দু'দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, বিদেশি চক্রের সঙ্গে জড়িত সব জালিয়াত চক্রকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কিসমত হায়াৎ সমকালকে বলেন, বিদেশি এ চক্রটি অভিনব অপরাধের সঙ্গে জড়িত। ইতিমধ্যে আমরা কিছু ক্লু পেয়েছি। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
২০১২ সালের ২৮ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ায় সে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংকিং খাত জালিয়াত চক্র ধরা পড়ে। ওই চক্রের প্রায় সবাই ছিলেন রোমানিয়ান নাগরিক, যাদের সঙ্গে জড়িত ছিল তাইওয়ান ও আফ্রিকার একাধিক চক্র। ওই চক্রের কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ নানা তথ্য উদ্ঘাটন করে। ওই তথ্য থেকে একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সমকালকে জানান, তথ্য জালিয়াতির সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক এবং ই-মেইল। ফেসবুক এবং ই-মেইলে ফিশিং লিংক ব্যবহার করা ছাড়াও বর্তমানে মোবাইল এবং অনলাইন ব্যাংকিং, কেনাকাটার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের লিংক, অ্যাড ওয়্যার, স্পাই ওয়্যার ব্যবহার করে প্রতারণা চলছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এ ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.