মীমের আর্তনাদ কেন বেঁচে গেলাম? by শর্মী চক্রবর্তী

তন্ময় নেই, ভাবতেই পারছি না। আমরা তো একসঙ্গে মরতে গিয়েছিলাম, আমি কেন বেঁচে গেলাম। আমি তন্ময়কে চাই বলেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন মীম।
আমাকে একদিন না দেখতে পারলে তন্ময় পাগল হয়ে যেতো। স্কুল না থাকলে প্রায়ই সে আমার বাসার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো একনজর দেখার জন্য। জানালার পাশে আমিও দাঁড়িয়ে থাকতাম তাকে দেখার জন্য। এসব আমি এখন কিভাবে ভুলবো। আমিও তন্ময়ের কাছে চলে যেতে চাই। আমরা ওয়াদা করেছিলাম, বাঁচতে হলে দু’জন একসঙ্গে বাঁচবো, মরলেও দু’জন একসঙ্গে মরবো। এজন্যই আমরা একসঙ্গে মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কেন আমি বাঁচলাম? তন্ময় আমাকে রেখে একাই কেন চলে গেল না ফেরার দেশে?’

শুক্রবার বাড্ডা থানায় বসে এভাবেই আর্তনাদ করছিল শেহরীনা রহমান মীম। এর আগে ভোরে হাতিরঝিলের রামপুরা অংশের প্রথম ব্রিজ থেকে প্রেমিক তন্ময়ের হাত ধরে আত্মহত্যার জন্য ঝাঁপ দিয়েছিল দু’জন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মীম বেঁচে যায়। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে। চোখের সামনেই পানিতে ডুবে মারা যায় তন্ময়। পুলিশ মীমকে আত্মহত্যা চেষ্টা ও আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে আদালতে পাঠায়। আদালত তাকে গাজীপুরের কিশোরী সংশোধনাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
মীম বলে, আমাকে জোর করে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল বাবা-মা। মা অসুস্থ থাকায় আমি কিছু বলিনি। নীরবে মেনে নিয়েছি তাদের সকল কথা। তবে আমার মনে সবসময় তন্ময়ই ছিল। তবে মীমের মা শাহীনা আক্তার বলেন, আমি জানতাম না আমার মেয়ের কারও সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। কখন বুঝতেও পারিনি এমন কোন সম্পর্কের কথা। আমার একটাই কথা যদি তাদের মধ্যে এমন কিছু থাকতো তাহলে সে আমাকে খুলে বলতো। আমি বিষয়টি দেখতাম। কিন্তু সে এমন কিছু করেনি। আমি তার জন্য ছেলে দেখেছি, সে কোন আপত্তিও করেনি। কাবিনও করেছে নিজ ইচ্ছায়। এত কিছুর পর আমি কি করে বলবো আমার মেয়ের তন্ময়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। কিছু না জানতে পেরে আমরা বিয়ের প্রস্তুতিও নিয়েছি।  বিয়ের প্রস্তুতিও শেষ করেছি। এখন আমি কিভাবে সবাইকে মুখ দেখাবো?
মেয়ের এই ঘটনার পর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী শাহিনা। বারবার মীমের নাম নিয়ে বিলাপ করছেন। তিনি বলেন, মীম আমাকে বলে মা আমি খালার বাসা থেকে মোবাইলে গান লোড করে আসি। এই বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এরপর সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে সে আর ঘরে আসছে না। তাই আমি নিজেই আমার বোনের বাসায় গিয়ে দেখি সেখানে মীম নেই। তারা জানায়, মীম তাদের বাসায় যায়নি। তখনও আমি জানি না মীম তন্ময়ের সঙ্গে গেছে। তখন তার বান্ধবীদের কাছে ফোন দিলাম তারাও কিছু বলতে পারলো না। তখন আমি তার স্কুলের শিক্ষকের কাছে  ফোন দিলে তিনি আমাকে তন্ময়ের মায়ের নাম্বার দেন। তখন জানতে পারি তাদের ছেলেকেও পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর থেকেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। একপর্যায়ে তারা তন্ময়ের লাশ খুঁজে পায় হাতিরঝিল লেকে। আর মীমকে জীবিত পাওয়া যায়। এত কিছু হওয়ার পরও তন্ময়ের পরিবার দাবি করছে, আমরা তার ছেলেকে হত্যা করেছি। যদি হত্যা হয় তাহলে আমাদের মেয়ে তো আমাদের কাছে থাকার কথা। এসব কথার তো কোন মানে হয় না। আর তারা দু’জনেই তো চেয়েছিল আত্মহত্যা করতে। এর মধ্যে আল্লাহর রহমতে মীম বেঁচে গেছে। আর এখন সে দায়ী হয়ে গেল।
অন্যদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তন্ময়ের পিতা একরামুল ইসলাম ও মা রোকসানা বেগম। গতকাল তাদের ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে বাবা-মা দু’জনই বিলাপ করছেন। যাকে সামনে পাচ্ছেন তাকেই জড়িয়ে ধরে বলছেন, তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও। আমি আমার ছেলেকে ছাড়া আর কিছু চাই না। পুরো পরিবারে বইছে শোকের ছায়া। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন এভাবে শেষ হয়ে যাবে তারা ভাবতেই পারেননি। তন্ময়ের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, তন্ময়কে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ জন্য তারা মামলার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন বলে জানালেন এক স্বজন। তবে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমএ জলিল বলেন, প্রাথমিক তদন্তে দু’জন প্রেম করে একসঙ্গে ঘর থেকে বের হয়েছিল বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। পরে তারা একসঙ্গে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য হাতিরঝিলের ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
তিনি বলেন, আত্মহত্যার চেষ্টা ফৌজদারি অপরাধ। আর অন্যকে আত্মহত্যার প্ররোচনা করাটাও অপরাধ। এ জন্য মেয়েটির বিরুদ্ধে এ দু’টি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় আদালত তাকে গাজীপুরের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.