জামায়াতকে বর্জন করে পরবর্তী নির্বাচনের আলোচনায় বসুন

(অর্থনীতি সমিতির গোলটেবিল বৈঠকে আহ্বান) বর্তমান সংকট ও তার উত্তরণ বিষয়ে এক আলোচনায় বিশিষ্ট নাগরিকরা পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে। এই নির্বাচন নিয়ে আলোচনার আর অবকাশ নেই। এখন পরবর্তী নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে দুই নেত্রী আলোচনা শুরু করুক। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াতে ইসলামী থাকতে পারবে না। কোনোভাবেই জামায়াতের সঙ্গে আপস হতে পারে না। বক্তারা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির দেশব্যাপী হত্যাসহ যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে তার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। জামায়াত-শিবির মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ করতে '৭১ সালের মতো মানুষ হত্যা করছে। তাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ হতে পারে না। রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের সন্ত্রাস রুখে দিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তারা। রাজধানীর গুলশানে হোটেল লেকশোরে গতকাল শনিবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি 'সহিংস রাজনীতি, সংকটে দেশ : ভবিষ্যৎ ভাবনা' শিরোনামের এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাতের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের আলোচকদের অনেকেই বলেন, এখনকার সহিংসতার কারণ শুধু নির্বাচন নয়; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ায় জামায়াত-শিবির দেশে পরিকল্পিত সন্ত্রাস চালাচ্ছে। বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমের একটি অংশ এর প্রতিবাদ না করে নির্বাচন স্থগিতের দাবি করছেন। তারা জামায়াতের সহিংসতাকে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন। বৈঠকে বেশ কয়েকজন আলোচক জামায়াতে ইসলামী এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেন। কেউ কেউ বলেন, জামায়াতকে বাদ দিয়ে দু'দল আলোচনায় বসুক। সংকটের সমাধান হয়ে যাবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে জামায়াতের এজেন্ডা আর নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে বিএনপির এজেন্ডা এক নয় বলে মনে করেন তারা।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, দেশে সন্ত্রাসের রাজনীতি শুরু হয়েছে। শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে তা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে এ সহিংসতা মোকাবেলা করতে হবে। নির্বাচন প্রশ্নে সমঝোতা হলেই সংকট শেষ হবে তা নয়। বিষয়টি এখন জনগণের বেঁচে থাকার সংকটে পরিণত হয়েছে। এখানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয় চেতনাসহ প্রত্যেকটি বিষয় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দেশে যা চলছে তা ভবিষ্যতের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। দেশে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা চলছে কি-না তাই মুখ্য বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ভোটার হত্যা করে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সব সময়ই কাম্য। কিন্তু বুঝতে হবে, যারা একে কেন্দ্র করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে চাইছে, তাদের উদ্দেশ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ করা। তারা সন্ত্রাস করছে । তাদের অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে।
অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকাতে এ সহিংসতা। এটি কোনোভাবেই হতে দেওয়া যায় না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার আগে সমঝোতা কয়েকটি শর্ত দিয়ে হতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা, জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখা, দুর্নীতি দমন এবং সহিংসতা বন্ধ করার শর্ত মেনে সমঝোতায় যারা আসতে চান কেবল তাদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে । তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের অর্থনীতি দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে। এখনই দমন করতে না পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এভাবে সহিংসতা চলতে থাকলে অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে।
অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, অর্থনীতির মধ্যে আরেকটি মৌলবাদী অর্থনীতি দাঁড়িয়ে গেছে। অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর অধীনে এখন ১২৫টি জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক, বীমাসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে এদের অর্থের জোগান দেওয়া হয়। এসব দিয়ে জামায়াত গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এই অপশক্তিতে রুখতে হবে। তিনি আরও বলেন, গত এক মাসে জামায়াতের সহিংসতায় পরিমাপযোগ্য ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে এক লাখ কোটি টাকা। দেশের কৃষক-শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশির ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ক্ষতির প্রকৃত অবস্থা আগামী এক বছরের মধ্যে টের পাওয়া যাবে।
বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল বলেন, যখন বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচন বন্ধ করতে এমনকি জামায়াতকেও নির্বাচন করতে দেওয়ার কথা বলেন তখন তিনি হতাশ হন। তার মতে, সমাধানের আগে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। প্রথমে জামায়াতকে পরিত্যাগ করতে হবে। তারপর আলোচনায় বসতে হবে। সহিংসতা বন্ধ না করলে নির্বাচন নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই। তার ভাষায়, 'আমি সুশীল-বুদ্ধিজীবী হতে চাই না। আমার ফিল্টার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। এই ফিল্টার দিয়ে আমি বিচার করি কার সঙ্গে থাকব কি থাকব না। জামায়াতকে কিছু বুদ্ধিজীবী লাই দিচ্ছেন, যা সত্যিই বিরক্তিকর।' তিনি বলেন, দুঃখ হয়, বড় বড় দু'একটি পত্রিকা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তারা কি বাংলাদেশের মানুষ নন_ প্রশ্ন রাখেন তিনি। নির্বাচন বন্ধে দুটি পত্রিকায় প্রকাশিত একই লেখার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, একই লেখা ইংরেজিতে ছাপা হয়ে পরের দিন বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন বন্ধের দায়িত্ব তাদের কে দিয়েছে_ প্রশ্ন রাখেন তিনি। তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'তোমাদের আওয়ামী লীগ-বিএনপি করতে হবে না, সুশীল হতে হবে না, বাংলাদেশকে ভালোবাসলেই হবে।' জাফর ইকবাল তার বক্তব্যে ১৬ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে ইইউ কূটনীতিকদের অংশগ্রহণ না করার সমালোচনা করেন।
মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, চলমান সহিংসতা আসলে নির্বাচনের জন্য নয়। এটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থামানোর জন্য হচ্ছে। সাঈদীর রায়ের পরে দেশে যা হয়েছিল তা কোনোভাবেই নির্বাচনের জন্য ছিল না। আমাদের প্রধান বিবেচ্য স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস। এর বাইরে গিয়ে কোনো মীমাংসা হতে পারে না।
২৯ ডিসেম্বর টিআইবিসহ ৪টি প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে সংলাপে নির্বাচন স্থগিতের যে সুপারিশ করা হয় গতকালের আলোচনা সভার কয়েকজন বক্তা তার সমালোচনা করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান তার বক্তব্যে এ বিষয়ে বলেন, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। ২৯ ডিসেম্বরের আলোচনায় আয়োজকরা নিজেরা কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান ঘোষণা করেননি। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের মধ্যে জামায়াতও থাকতে হবে, তা তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে সঠিক থাকলেও তা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়_ এমন কথা সরকারের মন্ত্রীরাও বলছেন। তিনি বলেন, রোববার নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে। তাই এখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে দুই নেত্রীর মধ্যে আলোচনা হতে পারে। এর জন্য অনতিবিলম্বে একটি সময় ঠিক করা যেতে পারে। তিনি বলেন, দেশ বর্তমানে অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সরকারকে কোনো পথ দেখাতে পারছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সঙ্গে আগামীকালের ( ৫ জানুয়ারি) নির্বাচনের তুলনা করা ঠিক হবে না। এ নির্বাচনে প্রায় ৫৫ থেকে ৬০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। প্রায় ৬০ ভাগ ভোটার ভোট দিতে আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। '৯৬-এর নির্বাচনে মাত্র ২৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিন্তু তা সফল হবে না। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, লক্ষ্য এক না থাকলে সংলাপ ফলপ্রসূ হয় না। এ কারণে খালেদা-হাসিনার সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না। তার মতে, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আপসের বিষয় নয়। নাগরিকরা যারা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশে বিশ্বাস করেন তাদের সংহতির বড়ই দরকার। তারা যদি সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হন তাহলে সংঘাত কমে আসবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর রশিদ বলেন, সহিংসতা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নয়। জামায়াত ও বিএনপির অবস্থান এক হয়ে গেছে। এ কারণে বিএনপি নির্বাচনে আসছে না। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নির্বাচন শেষ করে একাদশ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ব্যক্তির বিচার হলে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াতের বিচারের পথে বাধা থাকা উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি।
পরিবেশ আইনজীবী রিজওয়ানা হাসান বলেন, হরতাল ও অবরোধকে কেন্দ্র করে সহিংসতার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সুশীল কিংবা নাগরিক সমাজের রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকতে পারে। কিন্তু যে কোনো কিছুতেই বিভক্ত না হয়ে জনগণের সমস্যার বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলকে তারা চাপের মধ্যে রাখলে সংকট সমাধানে তা সহায়তা করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, যদি আরেকটি ২১ আগস্ট ঘটিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা করা হয় তাহলে অসাম্প্রদায়িক চেতনার লোকজনকে কচুকাটা করা হবে। তিনি ইসলামী ব্যাংকসহ জামায়াতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয়করণ দাবি করেন। আর কত সন্ত্রাস হলে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে_ প্রশ্ন রাখেন তিনি। তথ্য কমিশনার ড. সাদেকা হালিম নির্বাচন কমিশন ও দুদককে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দেন।
ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। একটা অভ্যুত্থানের আশায় তারা জামায়াত-শিবিরকে নামিয়েছিল। কিন্তু তা সফল হয়নি। তা না হলেও একটি সামরিক শাসন আসবে বলে তারা মনে করেছিল। তাও হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নান বলেন, এখনকার সংকট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে। ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি ৪২ বছরে দেশের উন্নয়নকে সইতে পারছে না। তারা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছে। বৈঠকে এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন চলমান সহিংসতায় ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে জোট পরিহারের আহ্বান জানান।
বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি কখনোই সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার পেতে পারে না। নারী নেত্রী রোকেয়া কবীর বলেন, যারা জনগণকে পুড়িয়ে মারছে তাদের জন্য সমান মাঠ তৈরির পরামর্শ কূটনীতিকদের পক্ষ থেকেও আসছে। তাদের এই অবস্থান দুঃখজনক। আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়া রহমান, রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহমদ আল কবির, সাংবাদিক নঈম নিজাম, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আবদুর রশিদ প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.