দ্রুতই একটি স্বাভাবিক নির্বাচন হতে হবে by শান্তনু মজুমদার

(দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন) আজ ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন। আজ দশম জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য জনসাধারণ ভোট প্রদান করবেন, এমনটিই নির্ধারিত। তবে যেভাবে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে আমরা মোটেই আনন্দিত বা আহ্লাদিত নই। হওয়ার কথাও নয়। কারণ এটা কোনো স্বাভাবিক নির্বাচন নয়। প্রধান দুটি পক্ষের একটি এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আরেকটি বর্জন করছে। শেষোক্তদের আহ্বান কেবল বর্জন নয়, প্রতিহত করারও। কেন দেশ আজকের অবস্থায় পেঁৗছাল তা নিয়ে নানা আলোচনা আছে; মতের ভিন্নতা আছে। কারও কারও মতে, নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্বের পরিণতিতেই আমরা আজকের অবস্থায় এসে ঠেকেছি। কথাটি আংশিক সত্য। ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রদ হয়। বিএনপি ও তার মিত্ররা চেয়েছে এ ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে। এজন্য তারা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। প্রথম দিকের কর্মসূচিগুলো ছিল কমবেশি শান্তিপূর্ণ। সরকার বাধা দিয়েছে তবে তা মাত্রা ছাড়ায়নি। কোনো পক্ষ পুরোপুরি অনমনীয় অবস্থানে পেঁৗছে গেছে বা সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব হবে না এমনটা কিন্তু একবারও মনে হয়নি ২০১২ সালের শেষ পর্যন্তও। কিন্তু ২০১৩ সালের শুরুর দিকে, ১৯৭১-এ যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের রায় আসার সময় থেকেই পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নিতে শুরু করে। আন্দোলনে যুক্ত হয় নাশকতা; শহর ছাড়িয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রামাঞ্চলেও। কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নয়, জাতিগত ও ধর্মগত সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হয় ব্যাপকভাবে। জাতিগত ও ধর্মগত সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে হামলা চলে দেশজুড়ে। অতীতেও হামলা হয়েছে। কিন্তু এবার ব্যাপারটা ঘটেছে অনেকটা একযোগে এবং দেশজুড়ে। এটা খুবই স্পষ্ট ছিল যে নির্বাচনকালে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এসব হিংস্রতা সংঘটিত হয়নি। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা তুমুল আন্দোলনের পাল্টা জবাব হিসেবেই দেশজুড়ে তাণ্ডব চালানো হয়েছে। তবে নির্বাচনের ব্যাপারটা একেবারেই বিবেচনায় রাখেনি হামলাকারীরা, তা বলা যাবে না। জাতিগত ও ধর্মগত সংখ্যালঘুদের ওপর টানা হামলার মধ্যে ভোটের মানচিত্রে পরিবর্তন নিয়ে আসার একটা চেষ্টা ছিল বৈকি।
আজ যে নির্বাচন হচ্ছে সেটা দেশে বা বিদেশে অংশগ্রহণমূলক হিসেবে বিবেচিত হবে না_ এ নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। আমি যতটা বুঝি এ ধরনের পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় যারা থাকে তাদের ওপর দায়ভার বেশি চাপে; তাই স্বাভাবিক। বিরোধী দল হিংসা-হানাহানি করছে, সংবিধান সমুন্নত রাখার প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে না এমন কথাবার্তা বলে সরকারপক্ষ পার পাবে না। যে ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবি নিয়ে বিরোধীরা এখন মাঠে, এক সময়ে তারা নিজেরাই এরকম দাবিতে সক্রিয় ছিল এবং তারা এটা আদায়ও করে নিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, তখন যৌক্তিক হলে এখন অযৌক্তিক কেন? সে সময় প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি বলে একটা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বটে কিন্তু সেটা নিতান্ত দুর্বল। আসলে কবুল করতে হবে যে 'আদি পাপ' ১৯৯০ সালেই হয়েছিল দ্বিতীয় সামরিক শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা নেওয়ার যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৬ সালে সংবিধানে ঢুকিয়ে 'পাপের মাত্রা' বাড়ানো হয়। ২০১৩ সালে এসে আমরা দেখলাম 'পাপ বাপকেও ছাড়ছে না' এবং নির্বাচনকালে অনির্বাচিত সরকারের দাবি সংসদীয় গণতন্ত্রের টিকে থাকার সম্ভাবনা ধরেই টান দিয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। উদ্বেগ দেখা দেওয়াটা স্বাভাবিক। আফটার অল এটা একবিংশ শতাব্দী। এতে বরং বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে কথা হচ্ছে এই যে উদ্বেগ প্রদর্শন কিংবা শুভেচ্ছা জারি রাখা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু নিদান বাতলে দেওয়া কিংবা নিদানে বাধ্য করার মতো ব্যাপার যাতে না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খেয়াল রাখা হচ্ছে কি? আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের উদ্যোগ এবং জাতিসংঘের উদ্যোগের মধ্যে একটা পার্থক্য চিহ্নিত করে রাখা দরকার। বলতে চাইছি এই যে, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের চেয়ে, সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জাতিসংঘের এগিয়ে আসাটা তুলনামূলকভাবে ভালো; সম্মানজনক। অবশ্য জাতিসংঘ প্রতি সেকেন্ডে সাম্রাজ্যবাদের বাঁধা-এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে, এমন ধরে নিলে বলার কিছু নেই।
বাংলাদেশ নিয়ে বছরখানেক ধরে কিছু-কিছু বিদেশি মিডিয়ার কথাবার্তা-লেখালেখিতে তৃতীয় বিশ্বের সব দেশকেই একই ছাঁদে ফেলে মাপামাপি করার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সব দেশকেই একই ছাঁদে ফেলে মাপামাপি করার রোগটা দেখতে পাচ্ছি। এটা 'আমরা তোমাদের ব্যাপারে সব কিছু বুঝে বসে আছি' জাতীয় একটি মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ মনে হয়। কিংবা এটা পরিস্থিতি বুঝতে পারার ক্ষেত্রে আলস্য কিংবা উদাসীনতাও হতে পারে। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিয়ে কিছু কিছু বিদেশি মিডিয়ার অবস্থান এ ধরনের ধারণা তৈরি করছে। কেউ কেউ চক্রান্তের কথা বলেন। তেমন কিছু জানি না বলে সেদিকে যাচ্ছি না।
ফিরে আসি নির্বাচনের কথায়। আজকের নির্বাচনটি স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য হবে না। একটি স্বাভাবিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে দ্রুত। যত দ্রুত এটা করা যাবে, ততই মঙ্গল।
শান্তনু মজুমদার :শিক্ষক; রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনুলিখন

No comments

Powered by Blogger.